বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ফেসবুকের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন এক শ্রেণীর মানুষের কাছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে, স্বপ্নের মতো। ঘরে বসে ভিডিও তৈরি করে হাজার হাজার, এমনকি লক্ষ লক্ষ টাকা আয়ের হাতছানি অনেকেই উপেক্ষা করতে পারেন না। কিন্তু একজন মুমিনের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের মাপকাঠি হলো কুরআন ও সুন্নাহ। দুনিয়ার এই সামান্য লাভের জন্য আখেরাতের অনন্ত জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ফেসবুক থেকে আয় করার বিষয়টি বাহ্যিকভাবে যতটা সরল মনে হয়, গভীর দৃষ্টিতে তা ততটাই জটিল এবং বিপজ্জনক। এই লেখায় আমরা সেই গভীরতার দিকেই দৃষ্টি দেব এবং বোঝার চেষ্টা করব, কেননা এই পথটি একটি ডিজিটাল ফিতনা।
একনজরে...
ফেসবুক থেকে ইনকামের মূল ভিত্তি
ফেসবুক থেকে মনিটাইজেশনের মাধ্যমে যে অর্থ আসে, তা হালাল হওয়ার জন্য দুটি বিষয় ঠিক হওয়া আবশ্যক:
- আপনার নিজের তৈরি কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু এবং
- যে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অর্থ আসছে, সেই বিজ্ঞাপন।
দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই দুটি ক্ষেত্রেই মারাত্মক আপত্তিকর ও সন্দেহজনক বিষয় জড়িত।
১. কনটেন্টের ফিতনা: যা ফেসবুকে দেখানো হয়
মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য এবং ভিউ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমে ফেসবুক কনটেন্ট নির্মাতারা প্রায়শই এমন সব বিষয়বস্তু তৈরি করেন, যা সরাসরি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। যেমন:
সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার: ফেসবুকের প্রায় সকল ভিডিওতেই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, গান বা বিভিন্ন সাউন্ড ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়, যা ছাড়া ভিডিওকে আকর্ষণীয় করা যায় না বলে মনে করা হয়। এই হারাম উপাদানযুক্ত কনটেন্ট থেকে অর্জিত আয় কীভাবে হালাল হতে পারে? রাসূল ﷺ বলেছেন,
আমার উম্মাতের মধ্যে অবশ্যই এমন কতগুলো দলের সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশমী কাপড়, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল জ্ঞান করবে। (সহীহ বুখারী ৫৫৯০)
বেপর্দা ও সৌন্দর্য প্রদর্শন: পারিবারিক ভ্লগ, ট্রাভেল ভ্লগ বা রান্নার ভিডিও, অনলাইন শপে পণ্য বিক্রির নামে নারীদের পর্দাহীনভাবে উপস্থাপন করা এখন একটি সাধারণ বিষয়। যেখানে আল্লাহ তা’আলা নারীদেরকে তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করতে নিষেধ করেছেন এবং পুরুষদের দৃষ্টি সংযত রাখতে বলেছেন (সূরা আন-নূর: ৩০-৩১), সেখানে অর্থ উপার্জনের জন্য নিজের স্ত্রী বা পরিবারের অন্য নারী সদস্যদেরকে লক্ষ লক্ষ পর-পুরুষের সামনে তুলে ধরা একটি মারাত্মক গুনাহের কাজ। এটি শুধু গুনাহই নয়, বরং পরিবারের আত্মমর্যাদাবোধকেও ধ্বংস করে দেয়।
অহেতুক ও অনর্থক কথাবার্তা: বহু কনটেন্টের বিষয়বস্তু হলো নিছক সময় নষ্টকারী প্র্যাঙ্ক, চ্যালেঞ্জ, নাচ-গান অথবা ব্যক্তিগত জীবনের অপ্রয়োজনীয় বিষয় তুলে ধরা। আল্লাহ তা’আলা সফল মুমিনদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন:
“আর যারা অনর্থক কথাকর্ম থেকে বিমুখ।” (সূরা আল-মুমিনুন: ৩)
যে কাজ মুমিনের পরিচয়বিরোধী, সেই কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে তা থেকে আয় করা কীভাবে বরকতময় হতে পারে?
রিয়া বা লৌকিকতা: নিজের জীবনযাত্রা, সম্পদ, সাফল্য বা ভ্রমণ—এসব কিছুকে ভিডিওর মাধ্যমে প্রকাশ করার প্রধান উদ্দেশ্যই থাকে মানুষের প্রশংসা কুড়ানো, যা ‘রিয়া’ নামক গোপন শিরকের অন্তর্ভুক্ত। রিয়া মানুষের সমস্ত নেক আমলকে ধ্বংস করে দেয়। রাসূল ﷺ বলেছেন,
‘‘আমি সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি তোমাদের ব্যাপারে ভয় পাই তা হলো শিরক আসগার বা ক্ষুদ্রতর শিরক। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন: হে আল্লাহর রাসূল, শিরক আসগার কী? তিনি বলেন: রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা। কিয়ামতের দিন যখন মানুষদেরকে তাদের কর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে তখন মহান আল্লাহ এদেরকে বলবেন, তোমরা যাদের দেখাতে তাদের নিকট যাও, দেখ তাদের কাছে তোমাদের পুরস্কার পাও কি না!’’ (আহমদ, আল-মুসনাদ ৫/৪২৮-৪২৯; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১০২। হাদীসটি সহীহ।)
২. বিজ্ঞাপনের ফিতনা: ফেসবুক থেকে আয়ের মূল উৎস
ধরে নিলাম, কোনো ব্যক্তি শতভাগ সতর্ক থেকে একটি সম্পূর্ণ হালাল কনটেন্ট তৈরি করল (যেমন: সঙ্গীতবিহীন একটি শিক্ষণীয় ভিডিও)। কিন্তু এরপরও তার আয় হারাম হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। কারণ:
বিজ্ঞাপনের উপর নিয়ন্ত্রণহীনতা: আপনার ভিডিওতে কোন বিজ্ঞাপন দেখানো হবে, তার উপর আপনার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফেসবুক তার অ্যালগরিদম অনুযায়ী সুদভিত্তিক ব্যাংক, হারাম বীমা কোম্পানি, জুয়া বা বেটিং অ্যাপ, অশ্লীল কন্টেন্টযুক্ত অ্যাপ বা হারাম পণ্যের (যেমন: মদ) বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করতে পারে।
যখন আপনার হালাল কনটেন্টের মাধ্যমে একটি হারাম পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়, তখন আপনিও সেই পাপের প্রচারের অংশীদার হয়ে যান। আল্লাহ তা’আলা কঠোরভাবে বলেছেন:
“সৎকাজ ও তাক্বওয়ার ব্যাপারে তোমরা পরস্পরকে সহযোগিতা কর, পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করো না” (সূরা আল-মায়েদা: ২)
আপনি হয়তো নিজে সুদের কারবার করছেন না, কিন্তু আপনার ভিডিওর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষ সুদী ব্যাংকের বিজ্ঞাপনের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। আপনার এই উপার্জন তখন এমন এক কূপের পানির মতো, যেখানে আপনার এক বালতি বিশুদ্ধ পানির সাথে দশ বালতি নাপাক পানি মেশানো হয়েছে। সেই মিশ্রিত পানি কি আর ব্যবহারের যোগ্য থাকে?
দানের ভিডিও: রিয়া ও হারাম আয়ের বিষাক্ত চক্র: কিছু মানুষ ফেসবুক থেকে অর্জিত এই সন্দেহজনক অর্থ দিয়ে গরীব-দুঃখীকে দান করে এবং সেই দানের দৃশ্য ভিডিও করে আবার ফেসবুকে আপলোড করে। এটি একটি শয়তানি চক্র, যার প্রতিটি ধাপই বিপজ্জনক:
- প্রথম ধাপ: সন্দেহজনক বা হারাম পন্থায় অর্থ উপার্জন করা হলো।
- দ্বিতীয় ধাপ: সেই অর্থ দিয়ে দান করে আত্মতৃপ্তি লাভ করা হলো যে, “আমি তো ভালো কাজ করছি”। অথচ আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র (হালাল) বস্তু ছাড়া কবুল করেন না। (সহীহ মুসলিম: ১০১৫)
- তৃতীয় ধাপ: দানের মতো একটি ইবাদতকে ভিডিও করা হলো, যা গ্রহীতার জন্য অবমাননাকর এবং দাতার জন্য ‘রিয়া’ বা লৌকিকতার এক বিরাট দরজা খুলে দেয়। যেখানে ইসলামে গোপনে দান করাকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে, সেখানে এটি তার বিপরীত।
- চতুর্থ ধাপ: সেই দানের ভিডিওকে আবার মনিটাইজ করে তা থেকে অর্থ উপার্জন করা হলো। অর্থাৎ, আপনি একজনের দারিদ্র্য এবং নিজের ইবাদতকে পণ্য বানিয়ে আবার সেই সন্দেহযুক্ত অর্থ উপার্জনের চক্রেই প্রবেশ করলেন।
এটিই হলো ডিজিটাল ফিতনা। যেখানে একটি ভালো কাজকে ব্যবহার করে একাধিক গুনাহের পথ তৈরি করা হচ্ছে এবং মানুষ সেটাকে ‘স্মার্ট ওয়ার্ক’ বা ‘ভালো কাজ’ বলে মনে করছে।
ফেসবুক থেকে আয়ের বর্তমান যে পদ্ধতি, যেখানে কনটেন্ট ও বিজ্ঞাপনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা প্রায় অসম্ভব, তা একজন মুমিনের জন্য ঈমানী পরীক্ষার শামিল। অল্প কিছু টাকার জন্য এই সন্দেহজনক পথে হাঁটা মানে নিজের পরকালকে আস্তে আস্তে শেষ করে দেওয়া। রাসূল ﷺ বলেছেন:
“এমন এক যুগ আসবে, যখন মানুষ পরোয়া করবে না যে, সে কোথা হতে সম্পদ উপার্জন করল, হালাল হতে না হারাম হতে।” (সহীহ বুখারী: ২০৫৯)
আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি সেই যুগের (অসতর্ক) মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হব, নাকি আল্লাহর উপর ভরসা করে অল্পে তুষ্ট থাকব এবং হালাল রিজিকের অন্বেষণে অবিচল থাকব? নিশ্চয়ই যে আল্লাহর জন্য কোনো হারামকে ত্যাগ করে, আল্লাহ তাকে তার চেয়েও উত্তম হালাল প্রতিদান দেন।