তাহাজ্জুদ: অনুতপ্ত বান্দার চোখের পানি

বিভাগ: বেসিক ইসলাম

সম্ভাব্য পড়ার সময়: ৩ মিনিট

গভীর রাত। চারপাশের পৃথিবী যখন ঘুমের চাদরে ঢাকা, তখন একদল মানুষ জেগে ওঠে। তারা জেগে ওঠে তাদের রবের ডাকে সাড়া দিতে, যিনি প্রতি রাতের শেষভাগে দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন। এই জেগে ওঠাই হলো ‘কিয়ামুল লাইল’ বা তাহাজ্জুদ। এটি কেবল একটি নফল ইবাদত নয়, এটি আল্লাহর সাথে প্রেমময় আলাপের এক সুবর্ণ সুযোগ, গুনাহগার বান্দার অনুতপ্ত অশ্রু ফেলার এক পবিত্র মুহূর্ত।

অথচ আমরা কতই না দুর্ভাগা! জীবনের নানা ব্যস্ততা, ক্লান্তি আর গাফেলতির অজুহাতে আমরা এই বরকতময় সময়টিকে হেলায় পার করে দেই। রাত জাগি, কিন্তু রবের সামনে দাঁড়ানোর জন্য নয়; জাগি দুনিয়াবি আড্ডা, সোশ্যাল মিডিয়া বা গুনাহের কাজে। শেষ রাতের এই অমূল্য সময় যখন আমাদের ক্ষমা ও কল্যাণের জন্য হাতছানি দেয়, আমরা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন অথবা অনর্থক কাজে লিপ্ত থাকি।

অনেকে আবার তাহাজ্জুদের মর্যাদা ও ফযীলত সম্পর্কেই জানেন না। তারা জানেন না যে, এই সময়ে আল্লাহর রহমতের দুয়ার কতটা প্রশস্ত থাকে। এই লেখাটি সেইসব ভাইবোনদের জন্য, যারা ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে চান এবং রবের সান্নিধ্যে এসে নিজের জীবনকে পরিবর্তন করতে চান।

রবের পক্ষ থেকে এক বিশেষ আহ্বান

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

মহামহিম আল্লাহ্ তা‘আলা প্রতি রাতে রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেনঃ কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আছে এমন যে, আমার নিকট চাইবে? আমি তাকে তা দিব। কে আছে এমন আমার নিকট ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব। (সহীহ বুখারী: ১১৪৫)

সুবহানাল্লাহ! স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা আমাদের ডাকেন ক্ষমা করার জন্য, আমাদের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করার জন্য।

তাহাজ্জুদ: কুরআনের আয়নায়

আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে রাতের ইবাদতের কথা উল্লেখ করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন:

“আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় কর তোমার অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে। আশা করা যায়, তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।” (সূরা আল-ইসরা, ১৭:৭৯)

আল্লাহ তা’আলা জান্নাতবাসীদের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন:

“রাতের সামান্য অংশই এরা ঘুমিয়ে কাটাতো। আর রাতের শেষ প্রহরে এরা ক্ষমা চাওয়ায় রত থাকত।” (সূরা আয-যারিয়াত, ৫১: ১৭-১৮)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন,

“আর যারা তাদের রবের জন্য সিজদারত ও দন্ডায়মান হয়ে রাত্রি যাপন করে।” (সূরা আল-ফুরকান, ২৫:৬৪)

আল্লাহর নেক বান্দারা রাতকে শুধু ঘুমানোর জন্য ব্যবহার করেন না, বরং এর একটি বড় অংশ রবের ইবাদতে কাটান এবং শেষ প্রহরে এসে নিজেদের গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হয়ে চোখের পানি ফেলেন, ক্ষমা চান।

আমরা কেন এই বরকত থেকে বঞ্চিত?

আমরা অনেকেই তাহাজ্জুদের গুরুত্ব বুঝি, কিন্তু আদায় করতে পারি না। এর পেছনে কিছু সুস্পষ্ট কারণ রয়েছে:

১. ফযীলত সম্পর্কে অজ্ঞতা: অনেকেই জানেন না যে এই ইবাদতের মর্যাদা কত বেশি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

“ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হলো রাতের সালাত।” (সহীহ মুসলিম: ১১৬৩)

আবদুল্লাহ ইবনু সালাম (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় এসে পৌছলেন, মানুষ তখন দলে দলে তার নিকট দৌড়ে গেল। বলাবলি হতে লাগলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসেছেন। অতএব তাকে দেখার জন্য আমিও লোকদের সাথে উপস্থিত হলাম। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখে বুঝতে পারলাম যে, এই চেহারা কোন মিথ্যুকের চেহারা নয়। তখন তিনি সর্বপ্রথম যে কথা বললেন তা এইঃ হে মানুষগণ! তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, খাদ্য দান কর এবং মানুষ ঘুমিয়ে থাকাবস্থায় (তাহাজ্জুদ) নামায আদায় কর। তাহলে নিশ্চয়ই তোমরা সহীহ-সালামতে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (তিরমিযী, ২৪৮৫)

২. দিনের বেলার গুনাহ: দিনের বেলার গুনাহ মানুষকে রাতের কিয়ামুল লাইল থেকে বঞ্চিত করে। যে চোখ দিনে হারাম দেখে, যে কান দিনে হারাম শোনে, সেই চোখ ও কানের জন্য শেষ রাতে রবের সামনে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। গুনাহ আমাদের অন্তরকে ভারী করে ফেলে।

৩. দুনিয়াবি ব্যস্ততা ও রাত জাগা: আমরা দুনিয়ার কাজের জন্য রাত জাগতে কুণ্ঠাবোধ করি না, কিন্তু আখিরাতের সঞ্চয়ের জন্য আমাদের ক্লান্তি চলে আসে। অনর্থক কাজে রাত জেগে আমরা ফজরই কাজা করে ফেলি, তাহাজ্জুদ তো অনেক দূরের বিষয়।

৪. আলস্য ও শয়তানের প্ররোচনা: শয়তান চায় না কোনো বান্দা রবের এত কাছাকাছি চলে যাক। তাই সে ঘুমের মাধ্যমে, আলস্যের মাধ্যমে আমাদের এই ইবাদত থেকে দূরে রাখে।

আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার ঘাড়ের পশ্চাদংশে তিনটি গিঠ দেয়। প্রতি গিঠে সে এ বলে চাপড়ায়, তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত, অতএব তুমি শুয়ে থাক। অতঃপর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে একটি গিঠ খুলে যায়, পরে উযূ করলে আর একটি গিঠ খুলে যায়, অতঃপর সালাত আদায় করলে আর একটি গিঠ খুলে যায়। তখন তার প্রভাত হয়, উৎফুল্ল মনে ও অনাবিল চিত্তে। অন্যথায় সে সকালে উঠে কলূষ কালিমা ও আলস্য সহকারে। (সহীহ বুখারী, ১১৪২)

তাহাজ্জুদ: পরিবর্তনের সোপান

যদি আপনি সত্যিই জীবনকে পরিবর্তন করতে চান, যদি চান আপনার গুনাহগুলো মাফ হয়ে যাক, যদি আপনি চান রবের সান্নিধ্যে চলে যেতে, তবে তাহাজ্জুদের কোনো বিকল্প নেই।

১. গুনাহ মাফের শ্রেষ্ঠ সময়: যখন চারপাশ নীরব, যখন লোকদেখানোর কোনো সুযোগ নেই, তখন অনুতপ্ত হৃদয়ে আল্লাহর সামনে দাঁড়ান। আপনার সারাদিনের ভুল, আপনার অতীতের গুনাহ—সবকিছু তাঁর সামনে পেশ করুন। (ইনশাআল্লাহ) আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করবেন। কারণ আপনার চোখের দু’ফোঁটা পানি আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয়।

২. আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

“তোমরা অবশ্যই রাতের ইবাদাত করবে। কেননা তা তোমাদের পূর্ববর্তী সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের নিত্য আচরণ ও প্রথা। রাতের ইবাদাত আল্লাহ তা’আলার সান্নিধ্য অর্জনের উপায়, পাপকর্মের প্রতিবন্ধক, গুনাহসমূহের কাফফারা এবং দেহের রোগ দূরকারী।” (সুনানে তিরমিযী, ৩৫৪৯)

৩. দোয়া কবুলের সুবর্ণ সুযোগ: আমাদের জীবনে কত চাওয়া-পাওয়া, কত বিপদ-আপদ! আমরা মানুষের কাছে হাত পাতি, কিন্তু যিনি সবকিছুর মালিক, তাঁর কাছে চাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়টিকেই ভুলে যাই। শেষ রাতে আল্লাহর দরবারে দোয়া করা, দোয়া কবুলের এক সুবর্ণ সুযোগ।

তাহাজ্জুদ: কীভাবে শুরু করবেন?

তাহাজ্জুদ শুরু করার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন আল্লাহর কাছে তাওফিক চেয়ে একটি দৃঢ় সংকল্প। দিনের বেলার গুনাহ পরিহার করা অপরিহার্য, কেননা পাপ অন্তরকে কঠিন করে এবং রাতের ইবাদত থেকে বঞ্চিত রাখে। এর পাশাপাশি, শেষ রাতে সতেজভাবে জেগে ওঠার জন্য রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তোলা একান্ত জরুরি।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

আল্লাহ এমন ব্যক্তিকে দয়া করুন, যে রাতে উঠে নিজেও সালাত আদায় করে এবং তার স্ত্রীকেও জাগায় এবং সেও সালাত আদায় করে। সে উঠতে না চাইলে তার মুখমণ্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়। আল্লাহ এমন নারীর প্রতিও অনুগ্রহ করুন, যে রাতে উঠে নিজে সালাত আদায় করে এবং তার স্বামীকেও জাগায়। সে উঠতে না চাইলে তার মুখন্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়। (সুনান আবূ দাউদ, ১৪৫০)

রাত যখন গভীর হয়, তখন আমরা যেন জেগে উঠি আমাদের রবের সাথে একান্তে কথা বলার জন্য। আমাদের অনুতাপের অশ্রুতে সিজদা ভিজিয়ে রবের কাছে ক্ষমা চাই। হয়তো এই তাহাজ্জুদের উসিলাতেই আল্লাহ আমাদের জীবনের সব গুনাহ মাফ করে দেবেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত করবেন।

শেয়ার:
guest

2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
shezan

ধন্যবাদ