একনজরে...
(১) তাওহিদের প্রতি দৃঢ় অবস্থান
ইব্রাহীম (আ.) মূর্তিপূজা ও শিরকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
নিশ্চয় ইবরাহীম ছিলেন এক উম্মত, আল্লাহর একান্ত অনুগত ও একনিষ্ঠ। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। আন-নাহাল ১৬ঃ১২০
(২) আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ
আল্লাহর হুকুম মানতে দ্বিধা করা যায় না। আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ জীবনের সর্বাবস্থায়, প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণীয়।
ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি রাব্বুল আলামীনের কাছে আত্মসমর্পণ করলাম” [সূরা বাকারা ২:১৩১]
(৩) আল্লাহর উপর অটল ভরসা-তাওয়াক্কুল
আল্লাহর উপর নির্ভরতা মুমিনের সবচেয়ে বড় শক্তি। বিপদে, পরীক্ষায়, প্রতিকূল পরিবেশেও সে আল্লাহর উপর ভরসা করে থাকে।
নমরুদের অগ্নিকাণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সময় ইব্রাহীম (আ.) বলেছিলেন, “আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম কার্যনির্বাহক”।(বুখারী ৪৫৬৩)
অতপর আল্লাহর হুকুমে অগ্নি শীতল হয়ে যায় এবং আল্লাহ আগুন থেকে তাকে রক্ষা করলেন (আল-আম্বিয়া ২১:৬৯, আল-আনকাবূত ২৯:২৪)। নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য।
(৪) দোয়ার গুরুত্ব
ইব্রাহীম (আ.) সর্বদা বিভিন্ন বিষয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। দোয়া হচ্ছে মুমিনের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার, যা ইব্রাহীম (আ.)-এর জীবন দিয়ে আমরা শিখতে পারি। ইব্রাহীম (আ.) তার দোয়ায় নিজের জন্য ও তার পরিবার ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সৎ জীবন, হেদায়েত, নিরাপত্তা, আল্লাহর রহমত ও কল্যাণ প্রার্থনা করতেন। এ দোয়াগুলো আমাদেরও অনুসরণীয়।
(৫) আল্লাহর জন্য ত্যাগ স্বীকার
আল্লাহর আদেশে নিজের আরাম, পরিবার, স্বার্থ সব কিছুই উৎসর্গ করা যায়। ইব্রাহীম (আ.) সেটিই আমাদের শিখিয়েছেন। ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন।
তিনি জন্মভূমি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, পরিবারকে মরুভূমিতে রেখেছিলেন এবং ইব্রাহীম (আ.) তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানির জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, যা আল্লাহর জন্য ত্যাগের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। (সূরা আস-সাফফাত ১০২-১০৭)
(৬) পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীলতা
পরিবারে ইসলামী শিক্ষার চর্চা এবং উত্তরসূরিদের ঈমান ও আমলের প্রতি যত্নবান হওয়া প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব। যেমনটা সূরা আল-বাকারা এর ১৩২ নম্বর আয়াতে এসেছেঃ
ইব্রাহীম ও ইয়াকুব এ সম্বন্ধে তাদের পুত্রগণকে নির্দেশ দিয়েছিল, ‘হে পুত্রগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য দ্বীনকে (ইসলাম ধর্মকে) মনোনীত করেছেন। সুতরাং আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) না হয়ে তোমরা অবশ্যই মৃত্যুবরণ করো না।’
তিনি স্ত্রী হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে মক্কার নির্জন প্রান্তরে রেখে গিয়েছিলেন আল্লাহর আদেশে,তাদের জন্য দোয়া করেছেন এবং নিয়মিত তাদের খোঁজখবর নিতেন (সহীহ বুখারী ৩৩৬৪)।
(৭) দাওয়াতে হিকমাহ
ইব্রাহীম (আ.) তাঁর পিতাকে দাওয়াত দিয়েছেন অত্যন্ত প্রজ্ঞাপূর্ণ ও শ্রদ্ধাশীল ভঙ্গিতে। সূরা মারইয়াম এর ৪২ নম্বর আয়াতে এর উল্লেখ রয়েছে-
যখন সে তার পিতাকে বলল, ‘হে আমার পিতা! যে শোনে না, দেখে না এবং তোমার কোন কাজে আসে না তুমি তার উপাসনা কর কেন?
এটি শিক্ষা দেয় যে, দাওয়াতের ক্ষেত্রে কেবল যুক্তি যথেষ্ট নয়; এর সাথে দরকার নম্রতা, সহানুভূতি ও ধৈর্য। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের ইসলামের পথে ডাকার সময়, তাদের আবেগ ও সামাজিক সম্পর্ক বিবেচনায় নিয়ে কথা বলা চাই। তাছাড়া, সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথমে তা আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করতে হয়। অন্যদিকে, ইব্রাহীম (আ.) এর দাওয়াত মূর্তিপূজাকারীদের প্রতি ছিল বুদ্ধিভিত্তিক, যুক্তিপূর্ণ, সাহসিকতাসম্পন্ন ও হিকমাহপূর্ণ। তিনি প্রশ্ন, যুক্তি, উদাহরণ এবং বাস্তব কৌশল ব্যবহার করে তাদের ভুল বিশ্বাস ভেঙেছেন এবং তাওহিদের দিকে আহ্বান করেছেন।
১. তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেনঃ
যখন সে তার পিতা ও তার কওমকে বলেছিল,
‘তোমরা কিসের ইবাদত কর’?
‘তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে মিথ্যা উপাস্যগুলোকে চাও’? (সূরা আস-সাফফাত: ৮৫–৮৬)
২. মূর্তির অসহায়তা তুলে ধরে তিনি বলেনঃ
তাহলে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদাত কর, যা তোমাদের কোন উপকার করতে পারে না এবং কোন ক্ষতিও করতে পারে না’? (সূরা আল-আম্বিয়া ২১:৬৬)
৩. বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করার আহ্বানঃ
ধিক্ তোমাদেরকে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের উপাসনা কর তাদেরকে! তবে কি তোমরা বুঝবে না? (সূরা আল-আম্বিয়া ২১:৬৭)
৪. বাস্তব উদাহরণ ও কৌশল ব্যবহারঃ
ইব্রাহীম (আ.) একবার কৌশলে সব মূর্তি ভেঙে ফেললেন, শুধু বড়টিকে অক্ষত রাখলেন। পরে বললেন;
বরং ওদের মধ্যে এই বড়টিই এরূপ করেছে। সুতরাং তোমরা ওদেরকেই জিজ্ঞেস কর; যদি ওরা কথা বলতে পারে। (সূরা আল-আম্বিয়া ২১:৬৩)
৫. তিনি নিজে সঠিক পথ গ্রহণ করে তা অন্যদের জন্য উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেনঃ
তিনি বলেন:
আমি একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর দিকে আমার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি যিনি আকাশমন্ডলী আর পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। (সূরা আল-আনআম: ৭৯)
(৮) অতিথিপরায়ণতা ও উদারতা
অতিথিপরায়ণতা শুধু সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি ইসলামের শিক্ষা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির উপায়। ইব্রাহীম (আ.) ছিলেন এই গুণের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
তোমার কাছে কি ইবরাহীমের সম্মানিত মেহমানদের বৃত্তান্ত এসেছে? যখন তারা তার কাছে আসল এবং বলল, ‘সালাম’, উত্তরে সেও বলল, ‘সালাম’। এরা তো অপরিচিত লোক। অতঃপর সে দ্রুত চুপিসারে নিজ পরিবারবর্গের কাছে গেল এবং একটি মোটা-তাজা গো-বাছুর (ভাজা) নিয়ে আসল। (আয-যারিয়াত ৫১:২৪-২৬)
(৯) নেতৃত্ব ও ইমামতি
ইসলামে নেতৃত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সৎ, জ্ঞানী, ন্যায়পরায়ণ এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তি নেতৃত্বের উপযুক্ত। ইব্রাহীম (আ.) ছিলেন শুধু একজন নবীই নয়, বরং তিনি ছিলেন একটি জাতির নেতা। আল্লাহ তাআলা তাঁকে ইমাম হিসেবে মনোনীত করেন। কোরআনে আল্লাহ বলেন–
যখন ইব্রাহীমকে তার প্রতিপালক কয়েকটি (নির্দেশ) বাক্য দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন, সুতরাং সে তা পূর্ণ (রূপে পালন) করেছিল। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে মানব-জাতির নেতা করব।’ (সূরা আল-বাকারা, ২:১২৪)
তিনি মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতেন, ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা করতেন, যা একজন আদর্শ নেতার বৈশিষ্ট্য।
(১০) অকুতোভয়
ইসলাম সাহস ও সত্যের পথে অটল থাকার শিক্ষা দেয়। ইব্রাহীম (আ.) ছিলেন অকুতোভয় ব্যক্তিত্বের নিদর্শন। তিনি একা হলেও মূর্তিপূজার বিরোধিতা করেন, নিজের পিতাকেও সত্যের দাওয়াত দেন এবং অত্যাচারীর সামনে নত হননি।
নমরুদের সামনে তিনি নির্ভয়ে বলেছিলেন,
আমার রব তিনিই’ যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। (সূরা বাকারা ২:২৫৮)
মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম ও অগ্নিকুন্ডের মুখে দৃঢ়তা তার অকুতোভয় চরিত্রের প্রতীক।
Leave a Comment