পোস্ট কনটেন্ট
আজকের মিডিয়া যৌনতাকেন্দ্রিক কেন?
কারণ, যৌনতার মার্কেট আছে। জনগণ যৌনতা চায়। তারা যৌনতা দেখতে চায়, ভোগ করতে
চায়। চাহিদা আছে, তাই ইন্ডাস্ট্রিগুলো সেই চাহিদার যোগান দিচ্ছে। ব্যস। তবে
জনগণের মধ্যে এ চাহিদা তৈরি করছে এই একই ইন্ডাস্ট্রিগুলো। মানুষের মাথার ভেতরে
তারা ক্রমাগত বিষ ঢোকাচ্ছে। একসময় মানুষ বিষে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
ঠিক একই কারণে আজ পৃথিবীজুড়ে মাদকাসক্তি বাড়ছে। কোনো স্বাভাবিক মানুষ বুকের
ভেতরে ধোঁয়া ঢোকাতে চায় না। কোনো স্বাভাবিক মানুষ ঘুম থেকে উঠে নিজের শিরার
মধ্যে বিষাক্ত কেমিক্যাল প্রবেশ করাতে চায় না। স্বাভাবিক অবস্থায় কেউ ভাত,
ফল-সবজি পচানো, কড়া গন্ধের, গা গোলানো তরল গিলতে চায় না। এগুলোর চাহিদা তৈরি
করতে হয়। মানুষের মধ্যে এসব চাহিদা তৈরির জন্য এই ইন্ডাস্ট্রিগুলো প্রতিবছর
বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে। বিজ্ঞাপনসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কারিগরির মাধ্যমে
মানুষকে ভাবতে শেখায় যে চাহিদাগুলো সহজাতভাবে তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে, আর তাই
এগুলো পূরণ করতে হবে।
মানুষের প্রাকৃতিক অধিকার আর প্রাকৃতিক চাহিদা অনুযায়ী কাজ করাই সবচেয়ে
নৈতিক-লিবারেল মানবাধিকার এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু এই
'অধিকার' আর 'চাহিদা'-গুলো আসলে কতটা প্রাকৃতিক, সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে না।
আর কোনো কিছু যদি প্রাকৃতিক হয়ও, তাহলে সেটা অনুযায়ী কাজ করতে আমরা নৈতিকভাবে
কেন বাধ্য হব সেটাও প্রশ্ন।
আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কেন যৌনতা ফেরি করে?
১) মানুষ অশ্লীলতায় লিপ্ত হলে লাভ কার‼️
যে অশ্লীলতা করছে তার কোনো লাভ নেই। সে নিজেকে ছোট করছে, অপমানিত করছে। এতে লাভ
আছে শয়তানের। শয়তান চায় মানুষ তার পদাঙ্ক অনুসরণ করুক, যাতে সে মানুষকে তার
সাথে জাহান্নামে নিয়ে যেতে পারে।
২) আর কার লাভ?
অশ্লীলতা আর অবাধ যৌনতা ছড়িয়ে পড়লে সমাজে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে।
এর মধ্যে এক নম্বর হলো ভোগবাদ। কেউ যখন নিজের সব শারীরিক কামনাবাসনা, সব
ফ্যান্টাসি চরিতার্থ করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন তার মধ্যে কোনো ধরনের
আত্মনিয়ন্ত্রণ আর কাজ করে না। এ ধরনের মানুষ খুব ভালো ভোক্তা আর ক্রেতা হয়।
যতক্ষণ পকেটে টাকা থাকে ততক্ষণ যা ইচ্ছে তা ই সে কেনে। যা ইচ্ছে তা ই করে। এ
ধরনের মানুষ সব সময় শরীরের তৃপ্তি আর আরাম খোঁজে। তার মধ্যে কাজ করে চাহিদা উদিত
হওয়ামাত্র তা পূর্ণ করার তীব্র তাড়না। কারণ তাৎক্ষণিকভাবে কামনাবাসনা তৃপ্ত
করায় সে নিজেকে অভ্যস্ত করে ফেলেছে। এ ধরনের মানুষ আসলে আদর্শ ভোক্তা। কাজেই
অশ্লীলতা এবং অবাধ যৌনতার প্রভাবে ভোগবাদ বাড়ে।
৩) ভোগবাদ বাড়লে কাদের লাভ?
বিভিন্ন কর্পোরেশান আর সরকারের লাভ, যারা এই নিরন্তর ভোগ থেকে মুনাফা অর্জন করে।
আজ আমরা চারপাশে তীব্র বস্তুবাদী এবং ভোগবাদী একটা সমাজ কেন দেখি? কারণ নিজের
কামনাবাসনাকে যে নিয়ন্ত্রণ করে, যে নিজেকে সংযত করে, সে ভালো ভোক্তা না। কোনো
শহরের অধিবাসীদের মধ্যে মদের আসক্তি বাড়লে যেমন মদবিক্রেতার লাভ, তেমনি মানুষকে
তাৎক্ষণিকভাবে কামনাবাসনা পূরণে অভ্যস্ত করে তুলতে পারায় কর্পোরেশানগুলোর
লাভ।
তা ছাড়া এভাবে একটা আত্মকেন্দ্রিক সমাজ গড়ে ওঠে। এমন সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা
সহজ। যে সমাজের মানুষ চরমভাবে আত্মকেন্দ্রিক, প্রত্যেকটা মানুষ যেখানে বিচ্ছিন্ন
দ্বীপের মতো—সেই সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সোজা। অন্যদিকে যে সমাজে মানুষের
মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ় হয়, ভালোবাসা এবং আনুগত্যের সম্পর্ক থাকে, মানুষ একে
অপরের জন্য আত্মত্যাগে প্রস্তুত থাকে—সেই সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন।
বিচ্ছিন্ন, একাকী মানুষদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। সংঘবদ্ধ সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা
কঠিন।
কিন্তু সংঘবদ্ধ সমাজের অংশ হতে হলে অনেক সময় নিজের কামনাবাসনা আর ইচ্ছের ওপর
সমাজের স্বার্থকে স্থান দিতে হয়। কোনো পরিবার তখনই মজবুত হয় যখন পরিবারের
সদস্যরা একে অপরের জন্য নিজ স্বার্থ আর চাহিদা বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকে।
অন্যদিকে ব্যক্তিবাদ মানুষকে শেখায় শুধু নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে নাফসি নাফসি,
নাফসি ! মানুষ যখন এভাবে চিন্তা করতে শুরু করে তখন ওই ক্ষমতাসীনরা লাভবান হয়,
যারা মানুষকে শয়তানী পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে চায়। এটাই হলো ভোগবাদী
আত্মকেন্দ্রিকতার চূড়ান্ত গন্তব্য।
৪) সমাজে অশ্লীলতা এবং অবাধ যৌনতার প্রসার ঘটানোর আরেকটা উদ্দেশ্য হলো মানুষের ভালোমন্দ নির্ধারণের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়া‼️
মানুষের যখন তাকওয়া থাকে না, তাকওয়া দূরের কথা প্রাথমিক পর্যায়ের শালীনতাবোধও
যখন থাকে না, তখন সত্যমিথ্যা আর ভালোমন্দের পার্থক্য করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
ক্ষমতাসীনরা লাভবান হয়। মানুষ যদি মন্দকে চিনতেই না পারে তাহলে মন্দকে প্রতিরোধ
করবে কীভাবে? ভালো কী, সেটাই যদি মানুষ না জানে তাহলে তারা কীভাবে খারাপ থেকে
ভালোর দিকে পরিবর্তন চাইবে? আজকের দিনে জঘন্য ধরনের সব কাজ হচ্ছে, কিন্তু কেউ
প্রতিবাদ করছে না। কেন?
আমার বাবা বেড়ে উঠেছিলেন সিরাজে। সিরাজ ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। সেখানে এক
চালের আড়তদার ছিল। পুরো সিরাজে যত চাল বিক্রি হতো সব তার হাত ঘুরে আসত। এই
আড়তদার একদিন চালের দাম ৫০% বাড়িয়ে দিলো। বেশি দাম মানে বেশি লাভ, তাই সে দাম
বাড়িয়ে দিলো। ইরানের মানুষ দু-বেলা ভাত খায়। কাজেই চালের দাম বাড়িয়ে দিলে
কিছু মানুষকে উপোস করত হবে। যারা আগে দারিদ্র্যসীমার ঠিক ওপরে ছিল তারা নিচে চলে
যাবে। নিঃসন্দেহে এটা যুলুম।
তখন বিশাল প্রতিবাদ হলো। বিক্ষোভ-মিছিল হলো। সেই আড়ত ঘেরাও হলো। সবাই চালের দাম
কমানোর দাবি জানাল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মানুষ রাস্তায়। নামল।
মুক্তবাজার অর্থনীতি কিংবা অন্য কিছুর দোহাই দিয়ে আড়তদারের পক্ষে কেউ সাফাই
গাওয়ার চেষ্টা করল না। কারণ, সবাই বুঝতে পেরেছিল যা হচ্ছে তা অন্যায়। এই যুলুম
বন্ধ করতে হবে।
কিন্তু মানুষের ভালো-মন্দ চেনার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেলে ক্ষমতাসীন অপরাধীরা যা
ইচ্ছে তা-ই করতে পারে। প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ নিয়ে তাদের আর মাথা ঘামাতে হয়
না। কারণ, অন্যায় যে হচ্ছে সেটাই বেশির ভাগ মানুষ বুঝতে পারে না।
৫) সমাজে অশ্লীলতা এবং অবাধ যৌনতার প্রসার ঘটানোর আরেকটা কারণ হলো,
মানুষ যখন ইচ্ছেমতো কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন অন্যায়কে
চিনতে পারলেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে কথা বলতে চায় না। অন্যায়ের প্রতিরোধ করার
মতো ইচ্ছাশক্তি আর সাহস তার মধ্যে থাকে না। তার মধ্যে একধরনের অভ্যস্ত আলস্য কাজ
করে। আল্লাহর আদেশ অমান্য করে, তাঁর বেঁধে দেয়া সীমালঙ্ঘন করে ক্রমাগত নফসকে
সন্তুষ্ট করার কারণে, তার মধ্যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো আত্মিক শক্তি আর
থাকে না।
ভোগবাদ, আত্মতুষ্টির পেছনে ছোটার মানসিকতা, এবং গুনাহতে অভ্যস্ত হয়ে পড়া সমাজকে
এভাবে দুর্বল করে এবং একসময় সভ্যতার ধ্বংস ডেকে আনে। অল্প কিছু ক্ষমতাসীন মানুষ
আজ খুব নিপুণভাবে মানবজাতির নফসকে উস্কে দিচ্ছে। মানুষকে ক্রমাগত উদ্বুদ্ধ করছে
যেকোনো মূল্যে তার কামনাবাসনা চরিতার্থ করতে। আর এই কাজকে বুদ্ধিবৃত্তিক বৈধতা
দিচ্ছে লিবারেলিসমের দর্শন। তৈরি হচ্ছে চরম মাপের আত্মকেন্দ্রিক, বস্তুবাদী আর
ভোগবাদী সমাজ। লিবারেলিসম মানুষকে শেখাচ্ছে ভোগ করো। নিজেকে তৃপ্ত করো। নিজেকে
সন্তুষ্ট করো—নাফসি নাফসি নাফসি‼️ আর এভাবেই ধ্বংস হচ্ছে সভ্যতা।
📖 বই: সংশয়বাদী
✒️ লেখক: ড্যানিয়েল হাকিকাতযু