ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) মহব্বত প্রসঙ্গে বলেন, এটি এমন একটি মর্যাদা যা লাভের আশায় প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতা করে থাকে আর নেক আমল যারা করতে চায় তারা সদা সচেষ্ট থাকে। পূর্ববর্তীগণ এই জ্ঞান অর্জনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন আর প্রেমিকরা এর জন্য সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছেন। এর সুগন্ধী বাতাসে বিচরণ করে থাকে। এটি অন্তর সমূহের খোরাক। এটি আত্মাসমূহের খাবার। এটি চক্ষুসমূহের শীতলকারী। এটি এমনই জীবন যে, কেউ এ থেকে বঞ্চিত হয় সে মৃতদের অন্তর্ভুক্ত হয়। এটি এমনই আলো, যে একে হারিয়ে ফেলে সে অন্ধকারের সমুদ্রে নিপতিত হয়। আল্লাহর শপথ, মহব্বতের অধিকারীরা দুনিয়া ও আখেরাতের সম্মান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁদের মাহবুবের সান্নিধ্যের পুরো হিস্সা ও গুনাবলী তাঁদের মাঝে ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল ।
আনাস ইবনু মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ও রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয়ে মসজিদে নববী হতে বের হচ্ছিলাম। এমন সময় মসজিদের দরজায় এক লোকের সাথে সাক্ষাৎ হলো। সে বলল, হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! কিয়ামত কবে সংঘটিত হবে? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কিয়ামতের জন্যে কি সম্বল সংগ্রহ করেছ? তিনি বলেন, তখন লোকটি নীরব থাকলো। তারপর সে বলল, হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি তো সেজন্যে বেশি পরিমাণ সালাত, সিয়াম ও সাদাকা-খয়রাত সংগ্ৰহ করিনি। তবে আমি আল্লাহ ও তার রসূলকে মুহাব্বাত করি। তিনি বললেন, তুমি তার সাথেই থাকবে যাকে তুমি মুহাব্বাত কর। 📖 সহীহ মুসলিম ৬৬০৮ (হাদীস একাডেমী), আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৬৩৯
সুতরাং যে আল্লাহকে মহব্বতকারীর মর্যাদা থেকে আল্লাহর মাহবুব হওয়ার মর্যাদায় উন্নিত হতে চায় তাঁর জন্য সংক্ষিপ্ত ব্যাখা সহকারে এমন দশটি উপায় পেশ করা হল, যেগুলো ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “মাদারিজুস সালিকীন” এ উল্লেখ করেছেন।
একনজরে...
আল্লাহর ভালবাসা অর্জনের দশটি উপায়
একঃ আল-কুরআনের অর্থ বুঝে, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও প্রতিপাদ্য বিষয় জেনে গভীর মনোনিবেশ সহকারে তেলাওয়াত করা।
কেউ আল্লাহর সাথে কথা বলতে চাইলে সে যেন আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে।
হাসান বিন আলী (রাঃ) বলেন, নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তীগণ আল-কুরআনকে তাঁদের রবের পক্ষ থেকে পত্রাদি ভেবেছিলেন। ফলে তাঁরা রাতের বেলায় এগুলোকে গভীর মনোনিবেশ সহকারে তেলাওয়াত করতেন আর দিনের বেলায় এর অন্তর্নিহিত অর্থ তালাশ করতেন।
ইবনুল জাওযী (রাহঃ) বলেন, মহাগ্রন্থ আলকুরআনের তেলাওয়াত কারীকে ভেবে দেখা উচিত, আল্লাহ্ তায়ালা কতই না করুনা প্রদর্শন করেছেন যে তিনি তাঁর কালামকে মানুষের বোধগম্য করে দিয়েছেন। আর তার এটাও জানা উচিত যে সে যা তেলাওয়াত করছে তা কোন মানুষের উক্তি নয়। সে তার অন্তরে কথক আল্লাহ্ তায়ালার মহানত্বকে উপস্থিত করে তাঁর কালামকে গভীর মনোনিবেশ সহকারে তেলাওয়াত করবে।
ইমাম নবভী (রহঃ) বলেন, তেলাওয়াতকারীর সর্ব প্রথম দায়িত্ব হলো সে তাঁর অন্তরে এভাব জাগ্রত করবে যে, সে আল্লাহর সাথে কথোপকথন করছে।
এ কারনেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একজন সাহাবী একটি সূরাকে তেলাওয়াত করে, সূরাটির অর্থ গভীরভাবে মনোনিবেশ করে এবং সূরাটিকে মহব্বত করে আল্লাহর মহব্বত অর্জন করতে সক্ষম হন। ঐ সূরাটি হল করুনাময়ের গুন সম্বলিত ‘সূরা এখলাছ।’ সেই সাহাবী নামাযে সূরাটি বারবার পড়তেন। যখন তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল তখন তিনি বলেন, এ সূরাটি করুনাময়ের গুন সম্বলিত, তাই আমি এটা পড়তে ভালবাসি। অতঃপর রাসূল ﷺ বললেন, ‘তোমরা তাকে খবর দাও নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাঁকে ভালবাসবেন।’
📖 সহীহ বুখারী ৭৩৭৫
অর্থের দিকে গভীরভাবে মনোনিবেশ করার লক্ষ্যে আয়াতটি বারবার পড়ার প্রয়োজন হলে পড়তে হবে। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসালাম ও তাঁর সাহাবীগণ এরূপ করেছেন। হযরত আবু যর (রাঃ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি একরাত একটি আয়াতকে বারবার তেলাওয়াত করে কাটিয়েছেন।
আয়াতটি হলোঃ
‘যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা আপনার বান্দা এবং যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন তবে আপনিই পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞ।’
দুইঃ ফরয কাজগুলো আদায়ের পাশাপাশি নফল কার্যাবলীর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা ।
রাসূল ﷺ বলেছেন:
আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন: যে ব্যক্তি আমার কোন বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতা করে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছি। আমি যা তার উপর যা ফরয করেছি আমার বান্দাহ্ তা ব্যতীত অন্য কোন পছন্দসই জিনিসের দ্বারা আমার অধিক নিকটবর্তী হতে পারে না। আর আমার বান্দাহ্ নফলের সাহায্যে আমার নিকটবর্তী হতে থাকে, এমনকি আমি তাকে ভালবাসতে থাকি। সুতরাং আমি যখন তাকে ভালবাসতে থাকি, তখন আমি তার কান হয়ে যাই; যা দ্বারা সে শোনে, তার চোখ হয়ে যাই; যার দ্বারা সে দেখে, তার হাত হয়ে যাই; যার দ্বারা সে ধরে এবং তার পা হয়ে যাই; যার দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কিছু চায় আমি অবশ্যই তাকে তা দেই। সে যদি আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, আমি তাকে অবশ্যই আশ্রয় দান করি।
📖 সহীহ বুখারী ৬৫০২ (তাওহীদ পাবলিকেশন)
উক্ত হাদীসে সফলকাম মুক্তিপ্রাপ্ত দু’ধরণের লোকের কথা সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে। এক ধরনের লোক হলো আল্লাহকে মহব্বতকারী, আল্লাহর ফরয কার্যাবলী যথাযথ আদায়কারী এবং আল্লাহর সীমানায় অবস্থানকারী মুমিনের দল। আর দ্বিতীয় ধরনের লোক হলো আল্লাহর মাহবুব তথা প্রিয় বান্দাদের দল যার ফরয কার্যাবলী যথাযথভাবে আদায় করে নফল কার্যাবলীর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
তিনঃ সর্বাবস্থায় ও সার্বক্ষণিক জিহ্বা, অন্তর, কাজ এবং অবস্থার মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করা। তাই যিকিরের পরিমান অনুযায়ী বান্দাহ আল্লাহর মহব্বতের অংশীদার হবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা বলেন, যতক্ষণ বান্দাহ আমার যিকির করে এবং আমার স্মরণে তাঁর ঠোটদ্বয় নড়াচড়া করে ততক্ষন আমি বান্দার সাথে থাকি।’ আল্লাহ্ বলেন,’আর তোমরা আমাকে স্মরণ কর আমি তোমাদের স্মরণ করব।’
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নিশ্চয় “আলমুফরিদুন” তথা অনন্য ব্যক্তিবর্গ কারা? তিনি বললেন আল্লাহর অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও মহিলাগণ। (সহীহ মুসলিম )
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন কোন সম্প্রদায় কোন মজলিস থেকে এমতাবস্থায় উঠে যে তারা এ মজলিসে আল্লাহর যিকির করেনি তখন তারা যেন মৃত গাধার দুর্গন্ধ থেকে উঠে থাকে এবং তাদের জন্য আক্ষেপ হবে।’
📖 আবূ দাউদ ৪৮৫৫, নাসাঈ, হাকেম প্রমুখ, সিলসিলাহ সহীহাহ আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা/৭৭
একব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে যখন বলল, হে আল্লাহর রাসুল,নিশ্চয়ই ইসলামের বিধিবিধানগুলো আমাদের উপর আধিক্যতা লাভ করেছে। তাই আমাদেরে এমন এক ব্যাপক বিষয় শিক্ষা দিন যা আমরা আঁকড়ে ধরব। উত্তরে তিনি বললেন, ‘তোমার জিহ্বা যেন সর্বদা আল্লাহর স্মরণে আপ্লুত থাকে।
📖 আলবানীর সহীহ সুনানে ইবনে মাজাহ
চারঃ কুপ্রবৃত্তির অত্যাধিক তাড়নার সময় নিজের প্রবৃত্তির উপর আল্লাহর মহব্বতকে অগ্রাধিকার দেয়া ।
যদিও আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া বা অর্জন করা কষ্ট সাধ্য ব্যাপার তাসত্বেও তার মহব্বত লাভে উদ্যোগী হওয়া। ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহর সন্তুষ্টিকে আল্লাহ ভিন্ন অন্যের সন্তুষ্টির উপর অগ্রাধিকার দেয়া যদিও এ পথে চলতে বিপদাপদের সম্মুখীন হতে হয় অথবা ভারী কষ্ট স্বীকার করতে হয় অথবা শক্তি সামর্থের অপ্রতুলতা পরিলক্ষিত হয়। তিনি আরাে বলেন, আল্লাহর সন্তুষ্টিকে আল্লাহ ভিন্ন অন্য সন্তুষ্টির উপর অগ্রাধিকার দেয়া মানে বান্দাহ এমন ইচ্ছা করবে, এমন কাজ করবে যার মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি আনয়ন করে। আর এটাই হলাে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে অগ্রাধিকারের নমুনা আর এ অগ্রাধিকারের সর্বোচ্চ স্তরে ছিলেন আল্লাহর রাসূলগণ আর বিশেষভাবে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সবকিছুর উপর অগ্রাধিকার দেয়ার ক্ষমতা শুধুমাত্র তিনটি উপায়ে লাভ হতে পারেঃ
১) কু-প্রবৃত্তির তাড়নাকে দমিয়ে রাখা।
২) কু প্রবৃত্তির বিরােধিতা করা।
৩) শয়তান ও তার দোসরদের সাথে সংগ্রাম করা ।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেন, মুসলমানের উচিত সে আল্লাহকে ভয় করবে আর কুপ্রবৃত্তি থেকে নফসকে নিষেধ করবে। শুধুমাত্র প্রবৃত্তি ও লালসার জন্য শাস্তি দেয়া হয় না বরং প্রবৃত্তির অনুসরণ এবং এর চাহিদার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেই শাস্তিবর্তায়। তাই কোন নফস, যখন কোন খারাপ ইচ্ছা করে আর ব্যক্তিটি নিজের নফসকে খারাপ থেকে নিষেধ করে তখন এ নিষেধটি আল্লাহর এবাদত ও সওয়াবের কাজে পরিনত হয়। (মাজমুউল ফাতাওয়া ৬৩৫/১০)
পাঁচঃ আল্লাহর নামসমূহ ও গুনাবলীকে অন্তকরণ দিয়ে অনুধাবন করা ।
আল্লাহর নামগুলােকে ভালভাবে অবলােকন করা এবং উত্তমভাবে জানা । আর এ জ্ঞানের বাগানসমূহে অন্তর দিয়ে বিচরণ করা। তাই যে আল্লাহ তায়ালাকে তাঁর নামাবলী, গুনাবলী ও কার্যাবলী সহ জানতে পারে সে অবশ্যই আল্লাহ্ তায়ালাকে ভালবাসবে।
ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বলেন, কাউকে জ্ঞানী বলে আখ্যায়িত করা যাবে না যতক্ষণ না সে আল্লাহকে জানবে আর এ পথের সন্ধান পাবে যে পথ তাকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌছিয়ে দেয়। আরও সে জানবে এ পথে চলার বিপদাপদ ও বাধা সমূহ। ফলে তার মধ্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে যা তার এ জ্ঞানের সাক্ষ্য বহন করবে। তাই আসল জ্ঞানী সেই যে আল্লাহ্ তায়ালাকে তাঁর নামাবলী, গুনাবলী ও কার্যাবলী সহ জানে অতঃপর তার কাজকর্মে আল্লাহকে সত্য প্রমানিত করে আর নিয়ত ও ইচ্ছাকে একমাত্র আল্লাহর জন্য একনিষ্ট করে। যে আল্লাহর গুনাবলী অস্বীকার করল সে নিশ্চিতভাবে ইসলাম ও ঈমানের ভিত্তিমূল ভেঙে দিল এবং ইহসানের বৃক্ষটি ধ্বংস করে দিল।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীস বর্নিত হয়েছে, তিনি বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহর নিরানব্বইটি নাম রয়েছে যে কেউ ঐ নামগুলাে মুখস্থ করল সে বেহশতে প্রবেশ করল।”
📖 সহীহ বুখারী ২৭৩৬ (তাওহীদ পাবলিকেশন)
ছয়ঃ আল্লাহর অবদান অনুদানের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য করা তার অগনিত বাহ্যিক ও গুপ্ত নেয়ামত ও করুনাকে অবলােকন করা।
আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এ ধরনের গভীর মনােনিবেশ বান্দাহকে আল্লাহর মহব্বতের দিকে সাড়া প্রদান করে।
বান্দাহ অনুদানের বন্দী। তাই নেয়ামত, করুনা ও অনুদান এমন মহৎগুণ যা মানুষের আবেগকে বন্দী করে ফেলে, মানুষের অনুভূতির উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে এবং বান্দাহকে ঐ সত্ত্বার ভালবাসার দিকে ধাবিত করে যিনি তার প্রতি করুণা করেছেন এবং তাকে কল্যানের পথ প্রদর্শন করেছেন। প্রকৃত পক্ষে পুরস্কার দানকারী এবং কল্যান ও ইহসান প্রদানকারী এক আল্লাহ ছাড়া আর কেহ নন।প্রকাশ্য বুদ্ধিমত্তা আর সহীহ রেওয়ায়াতই এর যথার্থ সাক্ষ্যবহন করে। তাই চক্ষুষ্মনদের কাছে বাস্তব ক্ষেত্রে মাহবুব আল্লাহ ছাড়া অন্য কেহ নন। সকল প্রকার মহব্বতের হকদার তিনি ভিন্ন অন্য কেহ নন।
মানুষ প্রকৃতিগত ভাবে তাকে ভালবাসে যে তার প্রতি ইহসান করে। তার সাহায্যে এগিয়ে আসে, তার শত্রুদের প্রতিহত করে এবং তার সকল উদ্দেশ্য লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করে। মানুষ যখন গভীর ভাবে চিন্তা করবে তখন সে জানতে পারবে যে তার প্রতি ইহসানকারী হচ্ছেন এককভাবে আল্লাহ তায়ালা। গুনে গুনে তার ইহসান ও দয়াগুলাের সংখ্যা নির্ধারণ করা যাবে না।
আল্লাহ্ ﷻ বলেন,
তিনি তোমাদেরকে সে সব কিছুই দিয়েছেন যা তোমরা চেয়েছ (তোমরা তোমাদের প্রয়োজনীয় সব কিছুই পেয়েছ) আর তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করতে চাইলে কক্ষনো তার সংখ্যা নির্ধারণ করতে পারবে না। মানুষ অবশ্যই বড়ই যালিম, বড়ই অকৃতজ্ঞ।
📖 সূরাঃ ইবরাহীম | আয়াত ৩৪
সাতঃ অন্তরকে পুরােপুরিভাবে আল্লাহর সামনে তুচ্ছ করে দেয়া।
আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার বিষয়ে এটি অন্য সব উপায় সমূহের মধ্যে অত্যাধিক গুরুত্বের দাবী রাখে। তুচ্ছ করা মানে নিজকে ছােট করে দেয়া, হেয় করে দেয়া ও অবনত করা।
আল্লাহ ﷻ বলেন,
দয়াময় আল্লাহর ভয়ে সবশব্দ ক্ষীণ হয়ে যাবে। সুতরাং মৃদুগুঞ্জন ব্যতীত তুমি কিছুই শুনবেনা।‘
📖 সূরাঃ ত্ব-হা | আয়াতঃ ১০৮
আর রাগীব ইস্পাহানী (রহঃ) বলেন, আয়াতে উল্লেখিত ‘আল খুশু’ মানে ক্ষীণ হয়ে যাওয়া। অধিকাংশ স্তরে খুশু’ শব্দটি অঙ্গপ্রতঙ্গের ক্ষেত্রে এবং দ্বরাআহ শব্দটি অন্তকরনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। তাই বলা হয়, যখন অন্তর তুচ্ছ হয়ে যায় তখন স্বভাবতই অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলাে ক্ষীণ হয়ে যায়।ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, আসলে খুশু’ হচ্ছে সন্মান, মহব্বত, তুচ্ছ ও ক্ষীণ সম্বলিত ভাবধারার সমষ্টি। আমাদের পূর্ববর্তীদের জীবন চরিত্রে আল্লাহর সামনে খুশুর আশ্চৰ্য্য অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। যা তাদের স্বচ্ছ ও পূতঃ অন্তরের সাক্ষ্য বহন করে।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ) যখন নামাযে দাড়াতেন তখন তাঁকে খুশুর কারণে, নির্জিব কাঠ মনে করা হত। তিনি যখন সেজদা দিতেন তখন চড়ুই পাখি তার পিঠের উপর দেয়ালের কাঠ খন্ড মনে করে বসে যেত।
হযরত আলী বিন হুসাইন (রাঃ) যখন অযু করতেন তখন তার রঙ হলুদ বর্নের হয়ে যেত। তাঁকে যখন বলা হল কি কারনে আপনাকে অযুর সময় এরূপ হতে দেখা যায়? তিনি বলেন, তােমরা কি জান আমি কার সামনে দাড়াইতে ইচ্ছা করছি।
আটঃ শেষ রাতে তাহাজ্জুদে আল্লাহর সাথে মােনাযাত ও তাঁর কালাম তেলাওয়াত করার নিমিত্তে তাঁর সাথে একাকিত্ব গ্রহন করা।
অন্তর দিয়ে আল্লাহকে বুঝা এবং তাঁর সামনে বান্দাহ সুলভ আদব নিয়ে আচরণ করা অতঃপর তাওবা ইস্তেগফারের মাধ্যমে এর ইতিটানা।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
تَتَجَافَىٰ جُنُوبُهُمْ عَنِ ٱلْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَـٰهُمْ يُنفِقُونَতারা তাদের (দেহের) পার্শ্বগুলো বিছানা থেকে আলাদা ক’রে (জাহান্নামের) ভীতি ও (জান্নাতের) আশা নিয়ে তাদের প্রতিপালককে ডাকে, আর আমি তাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তাত্থেকে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে।
নিশ্চয়ই রাতে ইবাদতকারীরা নিঃসন্দেহে আল্লাহর মহব্বতের অধিকারী বরং তারা মহব্বতের অধিকারীদের মধ্যে সেরা । এজন্য এটা কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় যে আকাশের আমীন জিব্রাইল (আঃ) যমীনের আমীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে নাযিল হয়ে বলেন, জেনে রেখাে মুমিনের মর্যাদা তার রাতে দাড়িয়ে এবাদত করার মাঝে আর তার ইজ্জত ও সম্মান হচ্ছে মানুষ থেকে নিজকে মুখাপেক্ষীহীন রাখার মধ্যে। 📖 সিলসিলাতুছ ছাহীহা
হাসান বাছরী (রহঃ) বলতেন, গভীর রাতে নামায পড়ার চেয়ে অধিক কষ্টকর কোন এবাদত আমি পাইনি অতঃপর তাকে বলা হল মুজতাহিদগন মানুষের মধ্যে সুন্দর চেহারার অধিকারী হওয়ার কারন কি? তিনি বললেন, কেননা তারা পরম করুনাময়ের সাথে একাকী মিলিত হয় । তাই তিনি তাদেরকে তার নূরের লেবাস পরিয়ে দেন। তাই, আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য রাতের ইবাদত জরুরি।
নয়ঃ সত্যিকারভাবে যারা আল্লাহকে ভালবাসে তাদের সাহচর্যতা অবলম্বন করা ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ ইরশাদ করেন আমার উদ্দেশ্যে পরস্পর মহব্বত কারীদের জন্য আমার মহব্বত অবধারিত হয়ে যায় । আমার উদ্দেশ্যে পরস্পর বৈঠককারীদের জন্য, আমার মহব্বত অবধারিত হয়ে যায়। আমার উদ্দেশ্যে পরস্পর সাক্ষাৎকারীদের জন্য ও আমার মহব্বত অবধারিত হয়ে যায়। শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। (মিশকাতুল মাছাবীহ) তাই কোন মুসলমানের আল্লাহ্ উদ্দেশ্যে তার ভাইকে মহব্বত করাই হচ্ছে তার সঠিক ঈমান ও উন্নত চরিত্রের ফল। ইহা একটি মযবুত বন্ধন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তার বান্দার অন্তরকে হেফাযত করেন এবং তার ঈমানকে এমনভাবে মযবুত করেন যাতে সে আর হারিয়ে না যায় অথবা দুর্বল না হয়ে পড়ে ।
দশঃ ঐ সকল কারণ থেকে দূরে থাকা যে গুলো আল্লাহ ও তাঁর বান্দার অন্তরের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দেয়।
আল্লাহর ভালোবাসা পেতে, ঐ সকল কারণ থেকে দূরে থাকা যেগুলো আল্লাহ ও তাঁর বান্দার অন্তরের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দেয়। তাই অন্তর যখন নষ্ট হয়ে যায় তখন ব্যক্তিটি তার দুনিয়ার কার্যাবলী তে যা ভাল করে তাতে কোন ফায়দা পায় না, আর পরকালে তো কোন কল্যাণ অথবা কোন অর্জনের ভাগী হয় ই না।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন উপকারে আসবে না’
📖 সূরা আশ-শুআ’রা | আয়াতঃ ৮৮
” আল্লাহর ভালবাসা অর্জনের দশটি উপায় ”
✒️ ইবনুল কায়্যিম রহিমাহুল্লাহ
📖 মাদারিজুস সালিকীন
সংকলনেঃ খালিদ আলে ফুরায়েজ
ভাষান্তরেঃ মুহাম্মদ ইসহাক আহমাদ