মানব জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় ও মানুষের চূড়ান্ত গন্তব্য

বিভাগ: কুরআন, বেসিক ইসলাম

সম্ভাব্য পড়ার সময়: ৩ মিনিট

কুরআন মাজিদ এবং হাদিস পড়লে জানা যায়, মানব ‘জীবন’-এর (রূহের) সৃষ্টি থেকে নিয়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছা পর্যন্ত মোট ছয়টি স্তর বা অধ্যায় রয়েছে। একটি অধ্যায় থেকে আরেকটি অধ্যায়ে রূহ স্থানান্তরিত (ইনতেকাল) হয়।

মানব জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়গুলো হলো:

  1. রূহের জগত
  2. মাতৃগর্ভ
  3. পৃথিবীর জীবন
  4. অন্তরাল জগত (বারযাখ)
  5. কিয়ামতকাল ও হাশর
  6. জান্নাত বা জাহান্নাম

মানব জীবনের এই ছয়টি অধ্যায়ের মধ্যে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পৃথিবীর এ জীবনটাকে কুরআনে বলা হয়েছে ‘হায়াতুত দুনিয়া’ বা পার্থিব জীবন। আর পৃথিবী থেকে জীবনের ইনতেকালের পরবর্তী তিনটি অধ্যায়কে বলা হয়েছে ‘আখিরাত’ ।

মানব জীবনের প্রথম অধ্যায়: রূহের জগত

প্রথম অধ্যায়টি সম্পর্কে সূরা আরাফের ১৭২ আয়াতে বলা হয়েছে;

স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক আদম সন্তানদের পৃষ্ঠ হতে তাদের বংশধরদের বের করলেন আর তাদেরকেই সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ; এ ব্যাপারে আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি।’ (এটা এজন্য করা হয়েছিল) যাতে তোমরা ক্বিয়ামাতের দিন না বল যে, ‘এ সম্পর্কে আমরা একেবারেই বে-খবর ছিলাম’। (আল-আ’রাফ | আয়াত ১৭২)

মানব জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়: মাতৃগর্ভ

মানব জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় অর্থাৎ মাতৃগর্ভ সম্পর্কে বলা হয়েছে:

আর আমি যাকে ইচ্ছে করি তাকে একটা নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত মাতৃগর্ভে রাখি, অতঃপর তোমাদেরকে বের করে আনি শিশুরূপে (আল-হজ্জ | আয়াত ০৫)

অন্যত্র মহান আল্লাহ ﷻ বলেন:

আর আল্লাহ তোমাদেরকে বের করেছেন, তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে এমতাবস্থায় যে, তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন শ্রবণশক্তি, চক্ষু ও অন্তর। যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় কর। (আন-নাহাল | আয়াত ৭৮)

মানব জীবনের তৃতীয় অধ্যায়: পৃথিবীর জীবন

মানব জীবনের তৃতীয় অধ্যায় অর্থাৎ পৃথিবীর জীবন তো আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এ জীবনটাকে কুরআনে বলা হয়েছে ‘হায়াতুদ দুনিয়া’। দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে বহু আয়াত কুরআন মাজিদে রয়েছে।

আর তারা দুনিয়ার জীবন নিয়ে উৎফুল্লতায় আছে, অথচ আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন খুবই নগণ্য। (আর-রাদ | আয়াত ২৬)

আর এ দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয় এবং নিশ্চয় আখিরাতের নিবাসই হলো প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত! (আল-আনকাবূত | আয়াত ৬৪)

মানব জীবনের এই তৃতীয় অধ্যায় দৈহিক জীবন। জীবনের এই দৈহিক রূপের সূচনা হয় দ্বিতীয় অধ্যায় অর্থাৎ মাতৃগর্ভ থেকেই। পৃথিবীর জীবনের অবসান ঘটে দৈহিক মৃত্যুর মাধ্যমে। তৃতীয় অধ্যায় থেকে চতুর্থ অধ্যায়ে ‘জীবন’ স্থানান্তরিত হয় দৈহিক মৃত্যুর মাধ্যমে। অর্থাৎ দেহ থেকে মানুষের রূহ, আত্মা বা জীবনকে আলাদা করে ফেলা হয় এবং তা বারযাখে স্থানান্তরিত করা হয়। এর ফলে মানব দেহের মৃত্যু হয়। এতে মানুষের জীবন পৃথিবী থেকে সম্পর্কহীন হয়ে যায় । এই দৈহিক মৃত্যু প্রতিটি মানুষের জন্যে অবধারিত। প্রত্যেককেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয় এবং হবেই। মৃত্যু থেকে পালাবার কোনো সুযোগ নাই।

এ  প্রসঙ্গে কুরআন মাজিদে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে:

“প্রত্যেক ব্যক্তিকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।” (আলে-ইমরান-৩:১৮৫;(২১:৩৫; ২৯:৫৭))

তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবে, যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান কর। (আন-নিসা | আয়াত ৭৮)

মানব জীবনের চতুর্থ অধ্যায়: বারযাখ জগত

দেহ থেকে বের করার পর মানুষের আত্মাকে যে জগতে ইনতেকাল (স্থানান্তর) করা হয়, সে জগতের নাম আলমে বারযাখ। বারযাখ মানে আড়াল বা অন্তরাল। ‘আলমে বারযাখ মানে- ‘অন্তরাল জগত। এ জগত পৃথিবীর জীবন এবং পুনরুত্থান – এ দুয়ের মধ্যবর্তী অন্তরালে অবস্থিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

যেদিন তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে সেদিন পর্যন্ত তাদের সামনে থাকবে বারযাখ। (আল-মুমিনুন | আয়াত ১০০)

মানব জীবনের পঞ্চম অধ্যায়: কিয়ামতকাল ও হাশর

অতপর আসবে মানব জীবনে পঞ্চম অধ্যায়। তখন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। পৃথিবীটা রূপান্তরিত হবে একটা উন্মুক্ত সমতল প্রান্তরে। কুরআনে এই সময়কালের নাম দেয়া হয়েছে (কিয়ামত কাল)। তারপর সেই নবরূপ পৃথিবীর বুকেই অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এসে সমবেত হবে সমস্ত মানুষ। মহান আল্লাহ ﷻ বলেন:

(সেদিনের কথা চিন্তা কর) যেদিন আমি পর্বতমালাকে চালিত করব, আর পৃথিবীকে দেখতে পাবে উন্মুক্ত প্রান্তর আর তাদের সববাইকে আমি একত্রিত করব, কাউকেও বাদ দেব না। (আল-কাহফ | আয়াত ৪৭)

মানব জীবনের এই পঞ্চম অধ্যায়েই বিচার এবং ফায়সালা করা হবে- কে সফল হলো, আর কে হলো ব্যর্থ? কে পুরস্কৃত হবে, আর কে হবে লাঞ্ছিত? কে জান্নাতের অধিকারী হবে, কে নিক্ষিপ্ত হবে জাহান্নামে? এই বিচার ফায়সালা অনুষ্ঠিত হবে নতুনভাবে সজ্জিত সমতল পৃথিবীর বুকেই।

মহান আল্লাহ তায়া’লা বলেন:

আর যমীন তার রবের নূরে আলোকিত হবে, আমলনামা উপস্থিত করা হবে এবং নবী ও সাক্ষীগণকে আনা হবে, তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করা হবে। এমতাবস্থায় যে, তাদের প্রতি যুলম করা হবে না। (আয-যুমার | আয়াত ৬৯)

প্রত্যেকের কাজের পূর্ণ প্রতিফল দেয়া হবে। লোকেরা যা করে তা তিনি খুব ভালভাবেই জানেন। (আয-যুমার | আয়াত ৭০)

মহান আল্লাহ তায়া’লা বলেন,

আর আমি প্রত্যেক মানুষের কর্মকে তার ঘাড়ে সংযুক্ত করে দিয়েছি এবং কিয়ামতের দিন তার জন্য আমি বের করব একটি কিতাব, যা সে পাবে উন্মুক্ত। (আল-ইসরা (বনী-ইসরাঈল) | আয়াত ১৩)

(তাকে বলা হবে) ‘পাঠ কর তোমার কিতাব, আজ তোমার হিসাব নেয়ার ব্যাপারে তুমিই যথেষ্ট।’ (আল-ইসরা (বনী-ইসরাঈল) | আয়াত ১৪)

সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ ভালো কাজ করলে, সে তা দেখতে পাবে। এবং কেউ অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করলে, তাও সে দেখতে পাবে। (আয-যিলযাল | আয়াত ৭-৮)

হাশর ময়দানেই মানুষকে দুই দলে বিভক্ত করা হবে:

  1. অপরাধী দল এবং
  2. পুণ্যবান দল।

যেদিন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে, সেদিন মানুষ (দুই ভাগে) বিভক্ত হয়ে যাবে। (আর-রুম | আয়াত ১৪)

(সে দিন বলা হবে) ‘হে অপরাধীরা! আজ তোমরা আলাদা হয়ে যাও। (ইয়াসীন | আয়াত ৫৯)

জীবনের শেষ অধ্যায়ে যাত্রা: জান্নাত বা জাহান্নাম

জীবনের পঞ্চম অধ্যায়ে বিচার ফায়সালা শেষে পৃথিবীর জীবনের কৃতকর্মের ফল ভোগ করার জন্যে, সব মানুষকে নিয়ে যাওয়া হবে তাদের জীবনের শেষ ও চূড়ান্ত অধ্যায়ে। অপরাধীদের ফেলে দেয়া হবে জাহান্নামে। আর আল্লাহভীরুদের পুরস্কৃত করা হবে জান্নাত দিয়ে;

আর কাফিরদেরকে দলে দলে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। (আয-যুমার | আয়াত ৭১)

আর যারা তাদের রবকে ভয় করেছে তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে (আয-যুমার | আয়াত ৭৩)

মানব জীবনের শেষ অধ্যায় অর্থাৎ জান্নাত এবং জাহান্নাম হবে চিরস্থায়ী। মহান আল্লাহ এ খবর মানুষকে আগেই জানিয়ে দিয়েছেন;

আর এ দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয় এবং নিশ্চয় আখিরাতের নিবাসই হলো প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত! (আল-আনকাবূত | আয়াত ৬৪)

মানুষের জীবন মৃত্যু যেমন তার নিজের ইচ্ছাধীন নয়, বরং আল্লাহর হাতে তেমিন পুনরুত্থান, বিচার, পুরস্কার এবং শাস্তির বিষয়টিও সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হাতে। এর প্রতিরোধ মানুষের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।

তাই মৃত্যু পরবর্তী জীবনের মুক্তি ও সাফল্যের জন্যে পার্থিব জীবনকে পুরোপুরি নিয়োজিত করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

শেয়ার:

Leave a Comment