হারাম উপার্জন: পর্ব ২ | ব্যাংকে চাকরি – সুদ ও এর ভয়াবহতা

বিভাগ: বেসিক ইসলাম, হালাল হারাম

সম্ভাব্য পড়ার সময়: ৪ মিনিট

বর্তমান সময়ে তরুণ প্রজন্মের কাছে ব্যাংকে চাকরি একটি অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষিত ও ‘স্বপ্নের পেশা’ হিসেবে বিবেচিত। আকর্ষণীয় বেতন, সামাজিক মর্যাদা এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা—এই সবকিছু তরুণদের এই পেশার দিকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। অনেক মুসলিম তরুণ-তরুণীও এই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন, হয়তো পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান না রেখেই, অথবা জানলেও দুনিয়াবী মোহে আচ্ছন্ন হয়ে।

কিন্তু একজন মুমিনের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি। যখন দুনিয়ার কোনো আকর্ষণীয় বস্তু বা পেশা আল্লাহর আদেশের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়, তখন মুমিনের জন্য ঈমানের এক কঠিন পরীক্ষা শুরু হয়। ব্যাংকিং খাতের চাকরি, বিশেষত প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর চাকরি, ঠিক এমনই একটি পরীক্ষা। এই লেখায় আমরা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে এই পেশার ভয়াবহতা এবং তা থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে আলোচনা করবো, ইনশাআল্লাহ।

সুদের ভয়াবহতা: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) বিরুদ্ধে যুদ্ধ

প্রচলিত ব্যাংকগুলোর মূল ভিত্তি হলো ‘সুদ’ বা ‘রিবা’। ইসলামে সুদকে এতটাই কঠোরভাবে হারাম করা হয়েছে যে, অন্য কোনো পাপের ক্ষেত্রে এত ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা আসেনি।

১. কুরআনের ঘোষণা: আল্লাহ তা’আলা সুদকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় হারাম ঘোষণা করেছেন এবং একে তাঁর ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতই। অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। (সূরা আল-বাকারাহ, ২: ২৭৫)

হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা যুলম করবে না এবং তোমাদের যুলম করা হবে না। (সূরা আল-বাকারাহ, ২৭৮-২৭৯)

চিন্তা করুন, এমন কোনো পাপ আছে কি, যার জন্য স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন? একজন মুসলিম কীভাবে এমন একটি কাজের সাথে যুক্ত থাকতে পারেন, যা তাকে সরাসরি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) প্রতিপক্ষ বানিয়ে দেয়?

২. হাদিসের বাণী: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সুদ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যক্তিকে লা’নাত/অভিশাপ দিয়েছেন। জাবির (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লা’নাত করেছেন সুদখোরের উপর, সুদদাতার উপর, এর লেখকের উপর ও তার সাক্ষী দু’জনের উপর এবং বলেছেন এরা সবাই সমান। (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ১৫৯৮)

একজন ব্যাংক কর্মকর্তা / কর্মচারী — তিনি ক্যাশিয়ার হোন, ম্যানেজার হোন, বা আইটি বিভাগে থাকুন তিনি কোনো না কোনোভাবে এই সুদভিত্তিক ব্যবস্থার লেখক, সাক্ষী অথবা সাহায্যকারী হিসেবে গণ্য হন। তারা প্রত্যেকেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর অভিশাপের অন্তর্ভুক্ত, যা এক ভয়াবহ পরিণতি।

সুদের পাপের তীব্রতা বোঝাতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরও বলেন:

জেনে শুনে এক দিরহাম পরিমাণ সুদ খাওয়ার গোনাহ আল্লাহর নিকট ৩৬ বার ব্যভিচার করার চেয়েও বড়। (মুসনাদে আহমদ ৫/২২৫, দারাকুত্বনী ২৯৫ নং, সিলসিলাহ সহীহাহ ১০৩৩ নং, মিশকাত ২৪৬ পৃঃ)

অন্য বর্ণনায় এসেছে: আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

সুদের গুনাহর সত্তরটি স্তর রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্র স্তর হলো আপন মাকে বিবাহ (যেনা) করা। (সুনান ইবনু মাজাহ ২২৭৪)

এই হাদিসগুলো থেকে স্পষ্ট যে, সুদের ভয়াবহতা কেবল অবাস্তব কিছু নয়, বরং তা জঘন্যতম পাপগুলোর অন্যতম।

ব্যাংকে চাকরি: পাপের সহযোগী হওয়া

একটি সুদভিত্তিক ব্যাংক একটি পরিপূর্ণ হারাম ব্যবস্থা। এর যে কোনো বিভাগে কাজ করা মানে হলো সেই হারাম ব্যবস্থাকে সচল রাখতে সাহায্য করা। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ আযাব প্রদানে কঠোর।” (সূরা আল-মায়িদাহ, ৫:২)

একটি সুদভিত্তিক ব্যাংকিং সিস্টেমে, প্রত্যেকেই “পাপ ও সীমালঙ্ঘনে” সহযোগিতা করছেন। তাই মূল পাপীর পাশাপাশি এর সহযোগীরাও সমানভাবে দোষী।

মানুষ কেন এই হারাম পেশার দিকে ঝুঁকে?

দুনিয়ার প্রতি মোহ এবং আখেরাতের প্রতি উদাসীনতা মানুষকে জেনেশুনে হারামের পথে ঠেলে দেয়।

  • আর্থিক নিরাপত্তা: উচ্চ বেতন ও সামাজিক নিরাপত্তার মোহ মানুষকে অন্ধ করে ফেলে।
  • সামাজিক মর্যাদা: “ব্যাংকার” হিসেবে আমাদের সমাজে যে একধরনের মর্যাদা পাওয়া যায়, তা অনেককে আকর্ষণ করে।
  • ঈমানের দুর্বলতা: আল্লাহর প্রতিশ্রুতির ওপর দৃঢ় বিশ্বাসের অভাব। মানুষ আল্লাহর ওয়াদার চেয়ে নিজের দক্ষতাকে রিজিকের জন্য বেশি নির্ভরযোগ্য মনে করে।
  • শয়তানের প্ররোচনা: শয়তান হারামকে চাকচিক্যময় করে পেশ করে এবং দারিদ্র্যের ভয় দেখায়।

পরিত্রাণের উপায়: আল্লাহর উপর ভরসা

যদি কোনো মুসলিম ভাই বা বোন ইতোমধ্যে এই পেশায় জড়িয়ে পড়েন, তবে তার হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আন্তরিকভাবে তওবা করে এই হারাম পথ থেকে ফিরে আসার সংকল্প করলে আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য উত্তম পথ খুলে দেবেন।

১. আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল (ভরসা): রিজিকের মালিক ব্যাংক নয়, রিজিকের মালিক আল্লাহ। এই বিশ্বাস অন্তরে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর মুত্তাকী বান্দাদের জন্য এমন স্থান থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করেন, যা তারা কল্পনাও করতে পারে না।

“যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।” (সূরা আত-তালাক, ৬৫: ২-৩)

এই আয়াতটি হলো সেই সকল মুমিনের জন্য সান্ত্বনা, যারা হারামের চাকচিক্যময় পথ বর্জন করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অপেক্ষাকৃত কঠিন পথ বেছে নেয়।

২. হালাল রিজিকের সন্ধান করা: ব্যাংকে চাকরিই রিজিকের একমাত্র পথ নয়। আল্লাহ তা’আলা তাঁর জমিনকে প্রশস্ত করেছেন। একজন দক্ষ ও পরিশ্রমী মানুষের জন্য হালাল উপার্জনের অগণিত পথ খোলা আছে। ব্যবসা, শিক্ষকতা, ফ্রিল্যান্সিং, কৃষি কাজ, কারিগরি কাজ; এই ধরনের হাজারো হালাল পেশা রয়েছে। হয়তো শুরুতে বেতন কম হতে পারে বা কষ্ট বেশি হতে পারে, কিন্তু সেই হালাল টাকায় যে বারাকাহ (বরকত) ও মানসিক প্রশান্তি রয়েছে, তা হারামের কোটি টাকায়ও নেই।

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

হে লোকসকল! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং উত্তম পন্থায় জীবিকা অন্বেষণ করো। কেননা কোন ব্যক্তিই তার জন্য নির্দ্ধারিত রিযিক পূর্ণরূপে না পাওয়া পর্যন্ত মরবে না, যদিও তার রিযিক প্রাপ্তিতে কিছু বিলম্ব হয়। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং উত্তম পন্থায় জীবিকা অন্বেষণ করো, যা হালাল তাই গ্রহণ করো এবং যা হারাম তা বর্জন করো। (সুনানে ইবনে মাজাহ ২১৪৪)

তিনি (ﷺ) আরও সতর্ক করে বলেছেন:

“হারাম (পস্থায় উপার্জিত সম্পদ) দ্বারা সৃষ্ট ও পরিপুষ্ট মাংস (দেহ)-এর জন্য (জাহান্নামের) আগুনই উপযুক্ত।” (সুনানে তিরমিযী ৬১৪ )

দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী। এই অল্প কয়েকদিনের সুখ-শান্তির জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আখেরাতের অনন্ত জীবনকে ধ্বংস করা কোনো বুদ্ধিমান মুমিনের কাজ হতে পারে না। ব্যাংকের আকর্ষণীয় বেতন এবং সামাজিক মর্যাদা—এ সবই দুনিয়ার এক মরীচিকা।

তাই, আসুন আমরা আল্লাহর বিধানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেই। যারা এই পেশায় আছেন, তারা দৃঢ় সংকল্প করুন, আল্লাহর ওপর ভরসা করে হালাল বিকল্পের সন্ধান করুন। আর যারা এই পেশায় আসার স্বপ্ন দেখছেন, তারা এই ভয়াবহ ফিতনা থেকে নিজেদের রক্ষা করুন। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকার এবং হালাল রিজিকে সন্তুষ্ট থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন।

হারাম উপার্জন নিয়ে প্রথম পর্ব পড়ুন: হারাম উপার্জন: পর্ব ১ | ফেসবুক থেকে আয় হালাল নাকি হারাম?

শেয়ার:
guest

1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
shezan

Thanks