হারাম উপার্জন: পর্ব ৩ | অনলাইন জুয়ার ভয়াবহতা ও এ থেকে পরিত্রাণ

বিভাগ: ফিতনা, মুসলিম চরিত্র, হালাল হারাম

সম্ভাব্য পড়ার সময়: ৫ মিনিট

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এটি মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, বিশেষ করে আয়-উপার্জনের বিষয়ে, সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেছে। ইসলামে হালাল (বৈধ) উপার্জনকে ইবাদতের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং হারাম (অবৈধ) উপার্জন থেকে কঠোরভাবে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদের জন্য পবিত্র ও হালাল রিযিক অন্বেষণের নির্দেশ দিয়েছেন।

কিন্তু বর্তমান যুগে প্রযুক্তির সহজলভ্যতার সাথে সাথে হারাম উপার্জনের বিভিন্ন পথও সহজতর হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী ও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে “অনলাইন জুয়া” / “Online Gambling“। যা আজ একটি নীরব মহামারির মতো আমাদের সমাজকে গ্রাস করছে। এই লেখায় আমরা কুরআন ও হাদিসের আলোকে জুয়ার ভয়াবহতা এবং এই ধ্বংসাত্মক ফিতনা থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো, ইনশাআল্লাহ।

কুরআন ও হাদিসের আলোকে জুয়ার ভয়াবহতা

ইসলামে জুয়াকে সুস্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এটিকে শয়তানের কাজ এবং ঘৃণ্য বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

১. জুয়া: শয়তানের ঘৃণ্য কাজ: আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে মদ ও জুয়াকে একসাথে উল্লেখ করে একে শয়তানের কাজ বলে অভিহিত করেছেন।

হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সূরা আল-মায়িদাহ, ৫:৯০)

এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা চারটি জিনিসকে নাপাক বলেছেন এবং এগুলোকে “শয়তানের কাজ” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি কঠোরভাবে এগুলো পরিহার করতে নির্দেষ দিয়েছেন।

২. শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী: জুয়া কীভাবে মানুষের আত্মিক ও সামাজিক ক্ষতি করে, তা আল্লাহ পরের আয়াতেই ব্যাখ্যা করেছেন:

শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না? (সূরা আল-মায়িদাহ, ৫:৯১)

এই আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, জুয়া: মানুষের মধ্যে শত্রুতা তৈরি করে (যে জিতে সে অহংকারী হয়, যে হারে সে হিংসা ও ক্রোধে জ্বলে)। পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ায়। মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করে দেয়। সালাত থেকে বিরত রাখে, যা ঈমান ও কুফরের মধ্যে পার্থক্যকারী।

৩. অন্যায়ভাবে সম্পদ ভক্ষণ: জুয়া হলো অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করার একটি নিকৃষ্টতম পন্থা। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। আর তোমরা নিজেরা নিজদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু। (সূরা আন-নিসা, ৪:২৯)

জুয়ায় অর্জিত অর্থ সুস্পষ্টভাবে অন্যায় পন্থায় অর্জিত। জুয়াড়ি ব্যক্তি কোনো প্রকার শ্রম বা বৈধ বিনিময় ছাড়াই অন্যের অর্থের মালিক হওয়ার নেশায় মত্ত থাকে।

৪. জুয়ার প্রতি সামান্যতম ঝোঁকও পাপ: জুয়া খেলা তো দূরের কথা, কাউকে ঠাট্টা করে জুয়া খেলার আহ্বান জানানোও ইসলামে পাপ হিসেবে গণ্য। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

যে ব্যক্তি কসম করে বলে যে, লাত ও উয্যার কসম, সে যেন ’লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে। আর যে ব্যক্তি তার সাথীকে বলে, এসো আমি তোমার সঙ্গে জুয়া খেলব, তার সাদাকা দেয়া কর্তব্য (সহীহ বুখারী, ৪৮৬০)

চিন্তা করুন, শুধু মুখে বলার কারণেই যদি কাফফারা হিসেবে সদকা করার নির্দেশ আসে, তবে যে ব্যক্তি সরাসরি এই পাপে লিপ্ত, তার অবস্থা কতটা ভয়াবহ!

জুয়ার আধুনিকায়ন ও বর্তমান সমাজের আসক্তি

অতীতে জুয়া নির্দিষ্ট আসর বা ক্লাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের কল্যাণে তা আজ প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। এটিই “জুয়ার আধুনিকায়ন”।

  • সহজলভ্যতা: বিভিন্ন বেটিং ওয়েবসাইট, টেলিগ্রাম বিভিন্ন গ্রুপ/চ্যানেল, গেমিং অ্যাপস, অনলাইন ক্যাসিনো, এমনকি কিছু কিছু অনলাইন গেম (যেমন লুডু, ক্যারম, কার্ড গেম) যেখানে টাকার বাজি ধরা হয়, তার সবই আধুনিক জুয়ার অন্তর্ভুক্ত।
  • প্রলোভন:ঘরে বসে লাখপতি“, “অল্প সময়ে ধনী” হওয়ার মতো চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা হচ্ছে।
  • সর্বস্তরে আসক্তি: দুঃখজনক হলেও সত্য, এই ফিতনায় শুধু তরুণ প্রজন্মই নয়, বরং অনেক বয়স্ক ব্যক্তিরাও আসক্ত হয়ে পড়ছেন। শিক্ষার্থীরা তাদের পকেটের টাকা, টিউশনির টাকা এতে ব্যয় করছে; অন্যদিকে কর্মজীবী বা অবসপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাদের সঞ্চয় বা পেনশনের টাকা পর্যন্ত বাজি ধরে নিঃস্ব হচ্ছেন।

জুয়ার ধ্বংসাত্মক পরিণতি: ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ

এই আধুনিক জুয়ার আসক্তি একজন ব্যক্তিকে শুধু আর্থিকভাবেই পঙ্গু করে না, বরং তাকে আত্মিক ও সামাজিকভাবেও ধ্বংস করে দেয়।

১. নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া: জুয়াড়ি ব্যক্তি প্রথমে শখের বশে শুরু করলেও দ্রুতই সে এক মারাত্মক মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। একবার হেরে গেলে সেই টাকা তোলার জন্য সে আবার বাজি ধরে এবং এভাবে এক অশেষ চক্রে সে আটকে পড়ে। তার মানসিক শান্তি বিদায় নেয়, সে তীব্র হতাশা, উদ্বেগ ও বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকে।

২. পরিবার ও সমাজের ক্ষতি: একজন জুয়াড়ির কারণে পুরো পরিবার ও সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

  • পারিবারিক অশান্তি: সে তার স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়। পরিবারে নিত্যদিন ঝগড়া, অশান্তি ও এক পর্যায়ে বিবাহ-বিচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটে।
  • ঋণের বোঝা: জুয়ার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে সে চড়া সুদে ঋণ নেয়, যা তাকে আরও গভীর বিপদে ফেলে।
  • অপরাধে জড়ানো: যখন বৈধ পথে টাকা জোগাড় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন সে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, প্রতারণা, এমনকি মাদক ব্যবসার মতো ভয়াবহ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এভাবেই সমাজ অপরাধীতে ভরে যায়।
  • আত্নহনের পথে চলে যাওয়া: জুয়াড়ি ব্যক্তি বিভিন্ন সময় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে এবং নিজেকে শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করে।

পরিত্রাণের উপায়: আলোর পথে ফিরা

যে ব্যক্তি এই পাপের অন্ধকারে ডুবে গেছেন, তার জন্য হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহর রহমত অসীম। তিনি তওবাকারীকে ভালোবাসেন। এই ধ্বংসের পথ থেকে ফিরে আসার জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা অপরিহার্য:

১. তওবাতুন নাসুহা (একনিষ্ঠ তওবা): সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠভাবে তওবা করা। তওবার শর্তগুলো হলো:

  • পাপটি সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা (তৎক্ষণাৎ জুয়া খেলা ছেড়ে দেওয়া)।
  • অতীতের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া
  • ভবিষ্যতে এই পাপে আর কখনো লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ় সংকল্প করা।

আল্লাহ বলেন:

হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর, খাঁটি তাওবা; আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত, নবী ও তার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে সেদিন আল্লাহ লাঞ্ছিত করবেন না। তাদের আলো তাদের সামনে ও ডানে ধাবিত হবে। তারা বলবে, ‘হে আমাদের রব, আমাদের জন্য আমাদের আলো পূর্ণ করে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন; নিশ্চয় আপনি সর্ববিষয়ে সর্বক্ষমতাবান।’ (সূরা আত-তাহরীম, ৬৬:৮)

২. সকল মাধ্যম বন্ধ করা: অনলাইন জুয়ার সাথে সম্পর্কিত সকল অ্যাপস, ওয়েবসাইট, ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ অবিলম্বে ডিলিট/আনইন্সটল ও ব্লক করে দিতে হবে। যেসব বন্ধু বা পরিচিত মহল এই কাজে প্ররোচিত করে, তাদের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে।

৩. হারাম অর্থের নিষ্পত্তি: জুয়া থেকে অর্জিত সকল হারাম অর্থ নিজের কাছে রাখা যাবে না। এই অর্থ সওয়াবের নিয়ত ছাড়া কোনো গরিব-মিসকিনকে সদকা করে দিতে হবে। এটি মূল মালিকের কাছে ফেরত দেওয়া সম্ভবপর নাও হতে পারে, তাই হারাম থেকে পবিত্র হওয়ার এটাই একমাত্র পথ।

৪. সালাত ও ইবাদতে মনোনিবেশ: জুয়া মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ করে। তাই ফিরে আসার জন্য সালাতে পূর্ণ মনোযোগী হতে হবে। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতের সাথে আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। কারণ আল্লাহ বলেন,

“নিশ্চয় সালাত অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে।” (সূরা আল-আনকাবূত, ২৯:৪৫)

৫. হালাল উপার্জনের সন্ধান করা: জুয়া ছেড়ে দেওয়ার পর হালাল রিযিকের প্রতি পূর্ণ মনোযোগী হতে হবে। রিযিকের মালিক আল্লাহ—এই বিশ্বাস  রাখতে হবে। উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

তোমরা যদি প্রকৃতভাবেই আল্লাহ্ তা’আলার উপর নির্ভরশীল হতে তাহলে পাখিদের যেভাবে রিযিক দেয়া হয় সেভাবে তোমাদেরকেও রিযিক দেয়া হতো। এরা সকালবেলা খালি পেটে বের হয় এবং সন্ধ্যা বেলায় ভরা পেটে ফিরে আসে। (সুনানে তিরমিযী, ২৩৪৪)

অল্প হলেও হালাল উপার্জনে যে মানসিক শান্তি ও বারাকাহ (বরকত) রয়েছে, তা কোটি টাকার হারাম উপার্জনেও নেই।

৬. ধৈর্য ও সাহচর্য: এই পথ থেকে ফিরে আসতে সময় লাগতে পারে এবং শয়তান বারবার প্ররোচনা দেবে। তাই ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং নেককার, আল্লাহভীরু মানুষদের সাহচর্যে থাকতে হবে। ভালো আলেমদের সঙ্গ এবং তাদের নসিহত গ্রহণ করতে হবে।

শান্তিময় জীবনের পথে…

জুয়া একটি মরীচিকা। এটি মুহূর্তের উত্তেজনার বিনিময়ে আপনার দুনিয়া ও আখিরাত দুটোই ধ্বংস করে দেয়। যে ব্যক্তি এই পাপ থেকে ফিরে এসে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং হালাল পথে জীবিকা নির্বাহের সংগ্রাম শুরু করে, আল্লাহ তার জীবনে অকল্পনীয় প্রশান্তি দান করেন।

একটি শান্তিময় জীবন, সুখী পরিবার ও হালাল সংসারের জন্য জুয়ার এই অন্ধকার পথ ছেড়ে আলোর পথে ফিরে আসার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়। আল্লাহর অসীম রহমতের কথা স্মরণ করুন:

বল, ‘হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো নাঅবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’। (সূরা আয-যুমার, ৩৯:৫৩)

আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে সকল প্রকার হারাম উপার্জন, বিশেষ করে জুয়ার মতো ভয়াবহ ফিতনা থেকে হেফাজত করুন এবং হালাল ও পবিত্র রিযিক অন্বেষণের তৌফিক দান করুন। আমীন।

শেয়ার:
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments