ইতিহাসের দিকে তাকালে সভ্যতা ও যৌনতার সম্পর্কের একটা প্যাটার্ন দেখা যায়। বারবার বিভিন্ন সভ্যতায় এই প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
প্যাটার্নটা কী?
সোশ্যাল অ্যানথ্রোপলোজিস্ট জন ড্যানিয়েল আনউইন ৫,০০০ বছরের ইতিহাস ঘেঁটে ৮৬টি আদিম গোত্র এবং ৬টি সভ্যতার ওপর এক পর্যালোচনা করেন। আনউইন এ গবেষণা শুরু করেন সভ্যতাকে অবদমিত কামনা-বাসনার ফসল হিসেবে দাবি করা ফ্রয়েডিয় থিওরি যাচাই করার জন্যে। কিন্তু ফলাফল দেখে হকচকিয়ে যান আনউইন নিজেই। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত Sex & Culture বইতে দীর্ঘ এ গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন তিনি। বিভিন্ন সভ্যতা ও সেগুলোর পতনে আনউইন দেখতে পান একটা স্পষ্ট প্যাটার্ন-
কোনো সভ্যতার বিকাশ সেই সভ্যতার যৌনসংযমের সাথে সম্পর্কিত। যৌনতার ব্যাপারে কোনো সমাজ যত বেশি সংযমী হবে তত বৃদ্ধি পাবে বিকাশ ও অগ্রগতির হার। সহজ ভাষায় বললে, সভ্যতার বিকাশের জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়মে বাঁধা স্বাভাবিক যৌনাচার আবশ্যিক। প্রাথমিক বিকাশের পর্যায়ে যৌনাচারের ক্ষেত্রে প্রতিটি সভ্যতার দৃষ্টিভঙ্গি থাকে অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত এবং এর ভিত্তি পারস্পরিক বিশ্বস্ততা।
বিস্মিত আনউইন আবিষ্কার করলেন, সুমেরিয়, ব্যাবলনীয়, গ্রিক, রোমান, অ্যাংলো- স্যাক্সনসহ প্রতিটি সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ঘটেছে এমন সময়ে যখন যৌনসংযম ও নৈতিকতাকে এসব সমাজে কঠোরভাবে মেনে চলা হতো। কিন্তু উন্নতিরসাথে সাথে প্রতিটি সভ্যতায় শুরু হয় অবক্ষয়। সফলতা পাবার পর সভ্যতাগুলো হারানো শুরু করে নিজেদের নৈতিকতা। সাফল্যের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে। তাদের মূল্যবোধ, প্রথা ও আচরণ। ক্রমেই উদার হতে শুরু করে যৌনতার ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি। বহুগামিতা, সমকামিতা, উভকামিতার মতো ব্যাপারগুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে এগুলোকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করে নেয় সমাজ। সামষ্টিক কল্যাণের ওপর ব্যক্তি স্থান দেয় তার নিজস্ব স্বার্থপর আনন্দকে।
যৌনাচার ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার, সমাজে এর কোনো নৈতিক বা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না-আজকের আধুনিক সভ্যতার আধুনিক মানুষগুলোর মতো এ মিথ্যে কথাটা বিশ্বাস করেছিল আগের সভ্যতাগুলোও। অবধারিতভাবেই একসময় সবার ভুল ধারণা ভাঙে, কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে যায় অনেক। একবার শুরু হয়ে গেলে আর থামানো যায় না অবক্ষয়ের চেইন রিঅ্যাকশান। অবাধ, উচ্ছৃঙ্খল যৌনাচারের সাথে সাথে কমতে থাকে সামাজিক শক্তি। কমতে থাকে সভ্যতার রক্ষণাবেক্ষণ ও উদ্ভাবনের সক্ষমতা। ক্রমশ কমতে থাকে সমাজের মানুষের সংহতি, দৃঢ়তা ও আগ্রাসী মনোভাব। আর একবার এই অবস্থায় পৌঁছবার পর সভ্যতার পতন ঘটে দুটি উপায়ের যেকোনো একটির মাধ্যমে-অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা অথবা আগ্রাসী শত্রুর আক্রমণ।
আনউইন উপসংহার টানেন, বিয়ে-পূর্ববর্তী ও বিয়ে-বহির্ভূত যৌনতা এবং অবাধ ও বিকৃত যৌনাচার যে সমাজে যত বেশি সে সমাজের সামাজিক শক্তি তত কম। যৌনতার ওপর যে সমাজ যত বেশি বাধানিষেধ আরোপ করে, তার সামাজিক শক্তি তত বাড়ে। এবং সবচেয়ে শক্তিশালী সমাজ হলো যেখানে যৌনতা এক বিয়েকেন্দ্রিক পরিবারের (Heterosexual Monogamy) মধ্যে সীমাবদ্ধ। আনউইনের মতে ৫,০০০ বছরের ইতিহাসজুড়ে, প্রতিটি সভ্যতা ও সমাজের ক্ষেত্রে এ কথা সত্য। ‘যেকোনো সমাজকে সামাজিক শক্তি অথবা যৌন স্বাধীনতার মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হবে। আর এর পক্ষে প্রমাণ হলো কোনো সমাজ এক প্রজন্মের বেশি এ দুটো একসাথে চালিয়ে যেতে পারে না।
আনউইনের এই উপসংহারকে বিভিন্নভাবে হয়তো ব্যাখ্যা করা সম্ভব, তবে ফিতরাহর ওপর থাকা সুস্থ চিন্তার কোনো মানুষের জন্য সত্যটা স্পষ্ট। এই উপসংহার বিস্ময়কর- বিস্ময়ের কারণ হলো এত দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসে, স্থান-কাল-পাত্রভেদে একই চক্রের পুনরাবৃত্তি চলছে। কিন্তু এ উপসংহার অপ্রত্যাশিত না।
আসুন দেখা যাক, আনউইনের গবেষণা থেকে আসলে আমরা কী কী জানতে পারছি:
- সমাজে ফাহিশা (অশ্লীলতা ও বিকৃতি) ও যিনা বাড়লে ভাঙন ধরে পরিবার এবং মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোতে।
- এর প্রভাব পড়ে সামাজিক সংহতি এবং সমাজের অন্তর্নিহিত নৈতিক শক্তির ওপর।
- ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে ভেঙে পড়তে শুরু করে সমাজ।
- প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই সমাজ ও সভ্যতাকেও নিয়ন্ত্রণ করে অপরিবর্তনীয় কিছু নিয়মাবলি। পার্থক্য হলো প্রকৃতির ক্ষেত্রে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে এই নিয়মগুলোর অস্তিত্ব আমরা ধরতে পারি। সমাজ-রাষ্ট্র-সভ্যতার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অতটা সহজ হয় না।
কিন্তু যিনি জোয়ার-ভাটা, দিন-রাত, শীত-গ্রীষ্মের নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তিনিই বেঁধে দিয়েছেন মানবসমাজ ও সভ্যতার নিয়মগুলোও। আর তাই এই নিয়ম ভঙ্গ করার পরিণতি আছে। নৈতিকতা, যৌনতার ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নির্ধারিত বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করা, তার অবাধ্য হওয়া শুধু ব্যক্তির ওপর প্রভাব ফেলে না; বরং প্রভাব ফেলে পরিবার, সমাজ ও প্রজন্মের ওপর। এর মূল্য চোকাতে হয় সবাইকে। আল্লাহ অনুমোদন দেননি এমন যেকোনো যৌনাচারে লিপ্ত হওয়া ও মেনে নেয়া নিস্তেজ করে সমাজের উদ্যম, অনুপ্রেরণা ও আধ্যাত্মিক শক্তিকে। শুরু হয় এক চেইন রিয়্যাকশন। ক্রমশ বেড়ে চলা বিকৃতির প্রতি শূন্য হতে শুরু করে মানুষ অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া। এক সময় বিকৃতি পরিণত হয় প্রচলন ও প্রথায়।
বইঃ চিন্তাপরাধ
লেখকঃ আসিফ আদনান