আরবী ভাষায় ইলম (علم) শব্দটি দ্বারা জ্ঞান, অনুধাবন ও উপলব্ধি করা কে বোঝানো হয়।
একনজরে...
ইলমের প্রকারভেদ
ইলম দুই প্রকার। যথাঃ
ফরযে আইনঃ শরী‘আত মানুষের উপর যেসব কাজ ফরয বা ওয়াজিব করে দিয়েছে, সেগুলোর হুকুম আহকাম ও মাসআলা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরয। ফরযে আইন ইলম হ’ল- ঈমানের খুঁটিগুলো জানা, ইসলামী শরী‘আতের ইলম- যেমন: ওযূ, সালাত, সিয়াম, হজ্জ ইত্যাদি, ইসলামের হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর জ্ঞান, মু‘আমালাত ও মু‘আশারাতের ইলম।
ফরযে কিফায়াঃ এটি স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ফরয না হলেও সামষ্টিকভাবে সকলের উপর ফরয। অর্থাৎ সমাজের কিছু ব্যক্তি তা হাসিল করলে সকলের পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে। আর কেউই হাসিল না করলে সকলেই দায়ী থাকবে। এ প্রকারের ইলম অনেক বিস্তৃত। কোন বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান লাভ করা তথা বিশেষজ্ঞ হওয়া, যা সবার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। যেমন ইসলামী শরী‘আতের জ্ঞান, প্রকৌশল বিদ্যা, চিকিৎসা বিদ্যা ইত্যাদি।
“আর মুমিনদের জন্য সংগত নয় যে, তারা সকলে একসঙ্গে অভিযানে বের হবে। অতঃপর তাদের প্রতিটি দল থেকে কিছু লোক কেন বের হয় না, যাতে তারা দীনের গভীর জ্ঞান আহরণ করতে পারে এবং আপন সম্প্রদায় যখন তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে, তখন তাদেরকে সতর্ক করতে পারে, যাতে তারা (গুনাহ থেকে) বেঁচে থাকে।” সূরা তওবা ৯:১২২
ইলম অর্জনের গুরুত্ব
১) আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি কলম যা ইলম অর্জন এর উপকরণ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করে তাকে আদেশ করেনঃ লিখ। কলম বলল, কি লিখব? তিনি বললেনঃ তাক্বদীর লিখ, যা হয়েছে এবং অনন্তকাল পর্যন্ত যা হবে সবকিছুই। তিরমিযী ২১৫৫
২) আদম আলাইহিস সালাম কে ফেরেশতাদের উপর মর্যাদা দেওয়ার কারণ ইলম
আর তিনি আদমকে নামসমূহ সব শিক্ষা দিলেন তারপর তা ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। সুতরাং বললেন, ‘তোমরা আমাকে এগুলোর নাম জানাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’।তারা বলল, ‘আপনি পবিত্র মহান। আপনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন, তা ছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয় আপনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’। আর যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, ‘তোমরা আদমকে সিজদা কর’। তখন তারা সিজদা করল, ইবলীস ছাড়া। সে অস্বীকার করল এবং অহঙ্কার করল। আর সে হল কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত।
সূরা বাকারা ২:৩১-৩৩
৩) মুসা আলাইহিস সালাম সম্মানিত নবী হওয়া সত্ত্বেও খিজির আলাইহিস সালামের কাছে ইলম অন্বেষণ করতে যান
মূসা তাঁকে বলল, ‘আমি কি আপনাকে এই শর্তে অনুসরণ করব যে, আপনাকে যে সঠিক জ্ঞান দেয়া হয়েছে, তা আমাকে শিক্ষা দেবেন’? সূরা কাহফ ১৮:৬৬
৪) উম্মতে মুহাম্মদীর প্রতি আল্লাহ তাআলার প্রথম ওহী ছিল পড়ো
পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ থেকে।পড়, আর তোমার রব মহামহিম।যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।তিনি মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না। সূরা আলাক ৯৬:১-৫
৫) ইলম অর্জন করা ফরজ
রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয।
সুনানে ইবনে মাজাহ ২২৪
৬) আল্লাহ রাসূলাল্লাহ ﷺ কে জ্ঞান বৃদ্ধির দুআ করতে নির্দেশ দিয়েছেন
তুমি বল, ‘হে আমার রব, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।’ সূরা ত্ব হা ২০:১১৪
৭) দ্বীনের ইলম লাভ কল্যাণের উপায়
রাসূলাল্লাহ ﷺ বলেছেন,
আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে দ্বীনের ‘ইল্ম দান করেন।
বুখারী ৭১
৮) ইলম লাভকারীকে ঈর্ষা করা যায়
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ কেবল দু’টি বিষয়ে ঈর্ষা করা বৈধ; সে ব্যক্তির উপর, যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, অতঃপর তাকে বৈধ পন্থায় অকাতরে ব্যয় করার ক্ষমতা দিয়েছেন; এবং সে ব্যক্তির উপর, যাকে আল্লাহ তা’আলা প্রজ্ঞা দান করেছেন, অতঃপর সে তাঁর মাধ্যমে বিচার ফায়সালা করে ও তা অন্যকে শিক্ষা দেয়।
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৭৩
৯) ইলম লাভকারী ব্যক্তি উত্তম
বল, ‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?’ বিবেকবান লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে। সূরা যুমার ৩৯:৯
১০) জান্নাত লাভ ও ফেরেশতাদের দ্বারা ডানা বিছানো,সমস্ত প্রাণীকুলের দুআ লাভ, উত্তম মর্যাদা ও নবীগণের ওয়ারিশ হওয়ার সৌভাগ্য লাভ হয় ইলম অর্জন এর দ্বারা
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের জন্য কোন পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ্ তার পরিবর্তে তাকে জান্নাতের পথসমূহের মধ্যে কোন একটি পথে পৌঁছে দেন। ফেরেশতারা জ্ঞান অন্বেষণকারীর সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেন। জ্ঞানীর জন্য আসমান ও যমীনের যারা আছে তারা আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও দু‘আ প্রার্থনা করে, এমনকি পানির গভীরে বসবাসকারী মাছও। আবেদ (সাধারণ ইবাদাতগুজারী) ব্যক্তির উপর ‘আলিমের ফাযীলাত হলো যেমন সমস্ত তারকার উপর পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদা। জ্ঞানীরা হলেন নাবীদের উত্তরসূরি। নাবীগণ কোন দীনার বা দিরহাম মীরাসরূপে রেখে যান না; তারা উত্তরাধিকার সূত্রে রেখে যান শুধু ইল্ম। সুতরাং যে ইল্ম অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে।
আবু দাউদ ৩৬৪১
১১) ইলম অর্জন এর উসিলায় রিযিক লাভ হয়
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে দুই ভাই ছিল। তাদের একজন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দরবারে উপস্থিত থাকত এবং অন্যজন আয়-উপার্জনে লিপ্ত থাকত। কোন একদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট সেই উপার্জনকারী ভাই তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল। তিনি তাকে বললেনঃ হয়তো তার ওয়াসীলায় তুমি রিযিকপ্রাপ্ত হচ্ছ।
তিরমিযী ২৩৪৫
১২) উপকারী ইলম সদকায়ে জারিয়া
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন মানুষ মারা যায় তখন তিন প্রকার আমল ব্যতীত তার সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়।
১. সাদাকায়ে জারিয়া অথবা
২. এমন ইলম যার দ্বারা উপকার সাধিত হয় অথবা
৩. নেককার সন্তান যে তার জন্য দু’আ করতে থাকে। মুসলিম ৪০৭৭
১৩) ইলম এর অধিকারীরা আল্লাহকে সর্বাধিক ভয় করে
আলেমগণ যেহেতু আল্লাহর কর্তৃত্ব, বড়ত্ব ও মহত্ত্ব সম্পর্কে অন্যদের তুলনায় অধিক অবগত সেহেতু আলেমরাই আল্লাহকে অধিক ভয় করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল আলেমরাই আল্লাহকে ভয় করে’। সূরা ফাতির ৩৫:২৮
ইলম অর্জন এর সঠিক উপায়
১) ইলম অর্জন এর জন্য প্রয়োজন বিশুদ্ধ নিয়ত
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ যে ইল্মের দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করা যায়, কোন লোক যদি দুনিয়াবী স্বার্থ লাভের জন্য তা শিক্ষা করে, তবে সে ক্বিয়ামাতের দিন জান্নাতের সুগন্ধি পাবে না।
সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৬৬৪
২) হকপন্থী আলিম এর অনুসরণ,তাদের সোহবত এবং তাদের বই পড়া
আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অন্তর থেকে ‘ইলম উঠিয়ে নেন না, কিন্তু দ্বীনের আলিমদের উঠিয়ে নেয়ার ভয় করি। যখন কোন আলিম অবশিষ্ট থাকবে না তখন লোকেরা মূর্খদেরকেই নেতা বানিয়ে নিবে। তাঁদের জিজ্ঞেসা করা হলে না জানলেও ফতোয়া প্রদান করবে। ফলে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে , এবং অন্যকেও পথভ্রষ্ট করবে।
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১০০
ইলম অর্জন এর পথে মূল প্রতিবন্ধকতা
১. সন্তুষ্ট হওয়া
ইলম অর্জন করে সন্তুষ্ট হওয়া অনুচিত। ইলমের প্রতি ভালবাসা, লোভ এবং তা অর্জনের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে মৃত্যু পর্যন্ত।
২. অহংকার
অহংকার ইলম হাসিলের পথে বড় অন্তরায়। অহংকারের কারণে অন্যান্য অনেক কল্যাণের সঙ্গে সঙ্গে ইলমের মতো মহা কল্যাণ থেকেও মানুষ বঞ্চিত হয়। অহংকার মুমিনের সাথে যায় না। মুমিন হবে বিনয়ী। ইলম অন্বেষণের ক্ষেত্রে হতে হবে আরো বেশি বিনয়ী।
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন, ‘লাজুক এবং অহংকারী ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করতে পারে না। সহীহ বুখারী, ইলম অধ্যায়
৩. অপছন্দনীয় লজ্জা
অনেকের ইলম শিক্ষা করার ইচ্ছা থাকে, কিন্তু লজ্জার কারণে শিখতে পারে না।
আনসারী নারীরা কতই না উত্তম! দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করার ক্ষেত্রে লজ্জা তাদের জন্য বাধা হয় না। -সহীহ বুখারী ইলম অধ্যায়
আলিমকে সম্মান করা
১. আলিমের মর্যাদা সাধারণের তুলনায় অনেক বেশি
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমাদের সাধারণ ব্যক্তির উপর আমার যতখানি মর্যাদা, ঠিক তেমনি একজন ‘আলিমের মর্যাদা একজন ‘আবিদের উপর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্, তাঁর ফেরেশতাগণ এবং আসমান-যামীনের অধিবাসীরা, এমনকি গর্তের পিঁপড়া এবং পানির মাছ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির জন্য দু’আ করে যে মানুষকে কল্যাণকর জ্ঞান শিক্ষা দেয়।
জামে’ আত-তিরমিজি, হাদিস নং ২৬৮৫
২.মানুষ আলিমদের মুখাপেক্ষী
মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা না জানো, তাহ’লে জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস কর’। সূরা নাহল ১৬:৪৩
৩.আল্লাহ আলেমের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিয়েছেন
মহান আল্লাহ বলেন,، ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করবেন’। সূরা মুজাদালা ৫৮:১১
Leave a Comment