আমাদের সমাজে এমন অনেক বিষয় প্রচলিত আছে, যেগুলোকে অনেকে কুসংস্কার মনে করেন, আবার অনেকে গভীরভাবে বিশ্বাস করেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো ‘বদনজর’ বা ‘Evil Eye’। কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে, ভালো ব্যবসা মন্দা হয়ে গেলে বা সুখী পরিবারে অশান্তি দেখা দিলে বয়স্করা প্রায়ই বলেন, “নজর লেগেছে“। আধুনিক যুক্তিবাদী মন হয়তো একে উড়িয়ে দিতে চাইবে, কিন্তু ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বদনজর কোনো কুসংস্কার নয়, বরং এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য।
বদনজর বা ‘আল-আইন‘ হলো এমন এক অদৃশ্য তীর, যা কোনো হিংসুক বা অতি-আগ্রহী ব্যক্তি থেকে অন্যের প্রতি নিক্ষিপ্ত হয় এবং তার ক্ষতিসাধন করে। বর্তমান সময়ে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, সাফল্য ও সৌন্দর্য প্রদর্শনীর বস্তুতে পরিণত হয়েছে, সেখানে বদনজরের প্রভাব ও ভয়াবহতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই লেখার উদ্দেশ্য হলো কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে বদনজরের বাস্তবতাকে তুলে ধরা, এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করা এবং এই অদৃশ্য শত্রু থেকে আত্মরক্ষার ইসলামী পদ্ধতিগুলো আলোচনা করা, যাতে আমরা নিজেদের পরিশুদ্ধ করতে পারি ও আল্লাহর সুরক্ষায় থাকতে পারি।
একনজরে...
বদনজর কী?
- হাসাদ (হিংসা) থেকে উদ্ভূত নজর: যখন কোনো ব্যক্তি অন্যের কোনো নিয়ামত দেখে ঈর্ষান্বিত হয় এবং মনে মনে ওই নিয়ামতটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কামনা করে। এই হিংসাপূর্ণ দৃষ্টি থেকে যে ক্ষতি হয়, তা-ই বদনজর।
- অতি-প্রশংসা বা বিস্ময় থেকে উদ্ভূত নজর: কখনো কখনো একজন মানুষ অন্যের কোনো কিছু দেখে খুব বেশি মুগ্ধ বা বিস্মিত হলেও বদনজর লাগতে পারে, যদি সে আল্লাহর প্রশংসা না করে। এমনকি একজন ভালো মানুষও অনিচ্ছাকৃতভাবে নজর দিয়ে ফেলতে পারেন, যদি তিনি ‘মাশাআল্লাহ’ বা ‘বারাকাল্লাহু ফিক’ (আল্লাহ বরকত দিন) না বলেন।
সুতরাং, প্রতিটি ‘হাসাদ’ (হিংসা) বদনজরের কারণ হতে পারে, কিন্তু প্রতিটি বদনজর হিংসা থেকে আসে না, কখনো কখনো শুধু বিস্ময় থেকেও আসতে পারে।
কুরআন ও হাদিসের আলোকে বদনজরের বাস্তবতা
ইসলামী আকিদার অন্যতম মূলনীতি হলো অদৃশ্যে বিশ্বাস করা। বদনজর সেই অদৃশ্য বিষয়গুলোর একটি, যার অস্তিত্ব কুরআন ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
কুরআনের প্রমাণ:
১. সূরা আল-ফালাক (হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আশ্রয়): বদনজরের অস্তিত্বের অন্যতম সুস্পষ্ট প্রমাণ হলো সূরা আল-ফালাক। আল্লাহ তা’আলা আমাদের এই সূরাতে আশ্রয় চাইতে শিখিয়েছেন:
“বল, ‘আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি ঊষার রবের কাছে… আর হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে’।” (সূরা আল-ফালাক, ১১৩: আয়াত ১ ও ৫)
হিংসুকের হিংসার সর্বোচ্চ প্রকাশগুলোর একটি হলো তার বদনজর, যা দ্বারা সে অন্যের ক্ষতি করে।
২. সূরা আল-কালাম (কাফিরদের দৃষ্টি): রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বদনজর দেওয়ার প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন:
“আর কাফিররা যখন উপদেশবাণী শুনে তখন তারা যেন তাদের দৃষ্টি দ্বারা তোমাকে আছড়ে ফেলবে, আর তারা বলে, ‘এ তো এক পাগল’।” (সূরা আল-কালাম, ৬৮:৫১)
ইমাম ইবনে কাসির (রহ.) সহ অনেক মুফাসসির এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এটি কাফিরদের হিংসাপূর্ণ বদনজরকেই বোঝানো হয়েছে, যা তারা রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি নিক্ষেপ করতো।
৩. সূরা ইউসুফ (সতর্কতামূলক ব্যবস্থা): ইয়াকুব (আ.) যখন তার পুত্রদের মিসরে পাঠাচ্ছিলেন, তখন তিনি তাদের এক দরজা দিয়ে প্রবেশ না করে ভিন্ন ভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে বলেন।
“সে বলল, ‘হে আমার ছেলেরা, তোমরা এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করো না, বরং ভিন্ন ভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ কর এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তের বিপরীতে আমি তোমাদের কোন উপকার করতে পারব না। হুকুম একমাত্র আল্লাহরই। তাঁরই উপর আমি তাওয়াক্কুল করছি এবং তাঁরই উপর যেন সকল তাওয়াক্কুলকারী তাওয়াক্কুল করে’।” (সূরা ইউসুফ, ১২:৬৭)
তাফসিরকারকরা বলেন, ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্ররা ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন ও সুঠামদেহী। তিনি ভয় করেছিলেন যে, যখন তারা সবাই একসঙ্গে এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে, তখন মানুষের মুগ্ধ বা হিংসাপূর্ণ দৃষ্টি (বদনজর) তাদের ওপর পড়তে পারে। এটি বদনজর থেকে বাঁচার জন্য একটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের শিক্ষা দেয়।
হাদিসের প্রমাণ:
হাদিস শরিফে বদনজরের বাস্তবতাকে অত্যন্ত জোরালোভাবে এবং স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে।
১. “বদনজর সত্য”: আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
বদ নযর লাগা সত্য। আর তিনি উল্কি অংকন করতে নিষেধ করেছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৭৪০)
জাবের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:
বদ নজর মানুষকে কবর পর্যন্ত পৌছে দেয় এবং উটকে পাতিলে । (সহীহ আল জামেঃ শাইখ আলবানী (রহঃ) সহীহ বলেছেনঃ ১২৪৯)
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
তোমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করো। কেননা বদনজর সত্য বা বাস্তব ব্যাপার। (ইবনে মাযাহ, হাদিস: ৩৫০৮)
২. তাকদিরকেও অতিক্রম করার সক্ষমতা: বদনজরের প্রভাব এতটাই দ্রুত ও শক্তিশালী যে, রাসূল (ﷺ) একে তাকদিরের সঙ্গে তুলনা করেছেন:
উবাইদ ইবনু রিফাআ আয-যুরাকী (রাহঃ) হতে বর্ণিত আছে, আসমা বিনতু উমাইস (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। জাফরের সন্তানদের তাড়াতাড়ি বদ-নজর লেগে যায়। আমি কি তাদেরকে ঝাড়ফুক করতে পারি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। কেননা, কোন জিনিস যদি ভাগ্যকে অতিক্রম করতে পারত তাহলে বদ-নজরই তা অতিক্রম করতে পারত। (তিরমিজি, হাদিস: ২০৫৯)
৩. বদনজরের কারণে গোসলের ঘটনা: একটি বিখ্যাত হাদিসে বদনজরের বাস্তব প্রভাব ও তার প্রতিকার বর্ণিত হয়েছে।
আবূ উমামা ইবনে হুনাইফ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমের ইবনে রবীআ (রাঃ) সাহল ইবনে হুনাইফ (রাঃ)-র নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তখন গোসল করছিলেন। আমের (রাঃ) বলেন, আমি এমন খুবসুরত সুপুরুষ দেখিনি, এমনকি পর্দানশীন নারীকেও এরূপ সুন্দর দেখিনি, যেমন আজ দেখলাম। অতঃপর কিছুক্ষণের মধ্যেই সাহল (রাঃ) বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন। তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট নিয়ে যাওয়া হলো এবং তাঁকে বলা হলো, ধরাশায়ী সাহলকে রক্ষা করুন। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা কাকে অভিযুক্ত করছো? তারা বললো, আমের ইবনে রবীআকে। তিনি বলেনঃ তোমাদের কেউ বদনজর লাগিয়ে তার ভাইকে কেন হত্যা করতে চায়? তোমাদের কেউ তার ভাইয়ের মনোমুগ্ধকর কিছু দেখলে যেন তার জন্য বরকতের দোয়া করে। অতঃপর তিনি পানি নিয়ে ডাকলেন, অতঃপর আমেরকে উযু করতে নির্দেশ দিলেন। তিনি তার মুখমণ্ডল , দু’ হাত কনুই পর্যন্ত, দু’ পা গোছা পর্যন্ত এবং লজ্জাস্থান ধৌত করলেন। তিনি আমেরকে পাত্রের পানি সকলের উপর ঢেলে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি সাহলের পেছন দিক থেকে পানি ঢেলে দেয়ার জন্য আমেরকে নির্দেশ দেন। (সুনান ইবনু মাজাহ, হাদিস: ৩৫০৯)
এই হাদিসটি প্রমাণ করে যে—
- বদনজর একজন সুস্থ মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ করে ফেলতে পারে।
- বদনজর শুধু হিংসুক নয়, বরং কোনো ভালো মানুষের মুগ্ধ দৃষ্টি থেকেও লাগতে পারে (যদি আল্লাহর প্রশংসা করা না হয়)।
- এর সুনির্দিষ্ট প্রতিকার ইসলামে রয়েছে।
৪. বদনজরের ভয়াবহতা (মৃত্যু): রাসূল (ﷺ) বদনজরের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন:
আমার উম্মতের মধ্যে তাকদীরের মৃত্যুর পর সর্বাধিক মৃত্যু বদ নজর লাগার দ্বারা হবে। (মুসনাদে বাযযার)
এই হাদিসগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বদনজর কেবল মানসিক বা কাল্পনিক বিষয় নয়, এটি একটি শারীরিক ও বাস্তবসম্মত ক্ষতি, যা আল্লাহর হুকুমে মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য, সম্পদ ও সম্পর্কের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট ও সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা
প্রাচীনকালে বদনজর লাগার জন্য মানুষকে সরাসরি দেখতে হতো। কিন্তু বর্তমান যুগে প্রযুক্তির কল্যাণে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক) কারণে, বদনজরের আশঙ্কা ও প্রভাব হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
- অবিরাম প্রদর্শনীর সংস্কৃতি: সোশ্যাল মিডিয়া হলো একটি “প্রদর্শনীর মঞ্চ“। এখানে মানুষ তাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো—দামি রেস্তোরাঁর খাবার, নতুন কেনা গাড়ি, বিলাসবহুল অবকাশ যাপন, সন্তানের কৃতিত্ব, স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গ মুহূর্ত, নতুন চাকরি—ইত্যাদি ফলাও করে প্রচার করে।
- অদৃশ্য হিংসুকের আক্রমণ: যখন কেউ তার আনন্দের মুহূর্ত শেয়ার করে, তখন তার ফ্রেন্ডলিস্টে বা ফলোয়ারদের মধ্যে শত শত বা হাজার হাজার মানুষ তা দেখে। এদের মধ্যে কে কোন দৃষ্টিতে দেখছে, তা জানার কোনো উপায় নেই। অনেকেই আছেন যারা নিজের জীবনের অপ্রাপ্তি বা দুঃখের সাথে ওই পোস্টের তুলনা করেন। এই তুলনা থেকে তাদের মনে অজান্তেই হিংসা (হাসাদ) বা আফসোস তৈরি হয়। এই হাজারো অদৃশ্য দর্শকের মধ্যে কারো হিংসাপূর্ণ দৃষ্টিই বদনজরের কারণ হতে পারে।
- “পারফেক্ট লাইফ” সিনড্রোম: সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাই একটি “নিখুঁত” জীবনের ছবি তুলে ধরে। এই নিখুঁত জীবনযাত্রা দেখে অনেকে হতাশায় ভোগেন এবং তাদের মনে এই নিয়ামতগুলো ধ্বংসের আকাঙ্ক্ষা জাগতে পারে, যা বদনজরের প্রক্রিয়াকে সহজ করে দেয়।
- বাস্তব উদাহরণ: হরহামেশাই শোনা যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব সুখী দম্পতি হিসেবে পরিচিতদের কিছুদিন পরই বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। অথবা, যার ব্যবসার সাফল্যের ছবি নিয়মিত পোস্ট করা হতো, হঠাৎ তার ব্যবসায় ধস নেমেছে। অথবা, কোনো শিশুর “কিউট” ছবি বা ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরই শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এগুলো সবই বদনজরের সম্ভাব্য উদাহরণ।
রাসূল (ﷺ) বলেছেন,
মুআয বিন জাবাল (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা তোমাদের প্রয়োজন পূরণে সফলতা অর্জনের জন্য তা গোপন রেখে (আল্লাহর নিকট) সাহায্য প্রার্থনা কর। কারণ, প্রত্যেক নিয়ামতপ্রাপ্ত হিংসিত হয়। (হাদীস সম্ভার, হাদিস: ২১৯১)
সোশ্যাল মিডিয়া এই হাদিসের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি চর্চা। এটি গোপনীয়তার বদলে প্রকাশ্য প্রচারণাকে উৎসাহিত করে, যা মানুষকে খুব সহজে হিংসুকের লক্ষ্যে পরিণত করে।
বদনজরের ভয়াবহতা ও প্রভাব
বদনজরের প্রভাব শুধু শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর ভয়াবহতা সুদূরপ্রসারী (নিম্নে এর কিছু ক্ষতি উল্লেখ করা হল):
- শারীরিক ক্ষতি: হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়া, দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা যা চিকিৎসায় ভালো হয় না, শরীরে অবসাদ, ত্বকের সমস্যা ইত্যাদি।
- মানসিক ক্ষতি: বিষণ্ণতা, কাজে বা ইবাদতে মন না বসা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া।
- আর্থিক ক্ষতি: ব্যবসায় হঠাৎ লোকসান, চাকরি চলে যাওয়া।
- সম্পর্কের ক্ষতি: স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অকারণ ঝগড়া, পরিবারে অশান্তি, মানুষের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়া।
- পড়াশোনায় ক্ষতি: ভালো ছাত্রের হঠাৎ পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়া, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া।
এর সবচেয়ে বড় ভয়াবহতা হলো, এটি মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই ধ্বংস করতে পারে। দুনিয়ায় সে তার নিয়ামতগুলো হারায়, আর এই কষ্টের কারণে সে যদি আল্লাহর প্রতি হতাশ বা ধৈর্যহীন হয়ে পড়ে, তবে তার আখিরাতও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আত্মশুদ্ধি, প্রতিরোধ ও প্রতিকার
বদনজরের এই ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে আত্মশুদ্ধি এবং ইসলামী নির্দেশিত প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য।
ক. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:
১. আত্মশুদ্ধি ও তাওহিদের বিশ্বাস: প্রথম ও প্রধান কাজ হলো নিজের অন্তরকে হিংসা থেকে মুক্ত করা। অন্যের ভালো কিছু দেখলে অন্তর থেকে তার জন্য বরকতের দোয়া করা। এই বিশ্বাস দৃঢ় করা যে, সবকিছুর প্রকৃত রক্ষাকর্তা একমাত্র আল্লাহ।
২. নিয়মিত জিকির ও দোয়া (রুকইয়াহ):
- সকাল-সন্ধ্যার জিকির: প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় রাসূল (ﷺ) নির্দেশিত দোয়াগুলো পাঠ করা বদনজরের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার।
- বদনজর থেকে হিফাযতের দোয়া: ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান এবং হুসাইন (রাঃ)-এর জন্য নিম্নোক্ত দু‘আ পড়ে পানাহ চাইতেন আর বলতেন, তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আঃ) ইসমাঈল ও ইসহাক (আঃ)-এর জন্য দু‘আ পড়ে পানাহ চাইতেন। আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালিমার দ্বারা প্রত্যেক শয়তান, বিষাক্ত প্রাণী এবং প্রত্যেক কুদৃষ্টির অনিষ্ট হতে পানাহ চাচ্ছি। (সহীহ বুখারী, হাদিস: ৩৩৭১)
- এই দোয়াটি ৩ বার পাঠ করা: “বিসমিল্লা-হিল্লায়ী লা ইয়াযুররু মা’আসমিহি শাইয়ুন ফিল আরযি, ওয়ালা ফিস সামায়ি ওয়া হুয়াস সামীউল আলীম”। (অর্থঃ “আল্লাহ তা’আলার নামে” যার নামের বারাকাতে আকাশ ও মাটির কোন কিছুই কোন অনিষ্ট করতে পারে না। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।”) (তিরমিজি, হাদিস: ৩৩৮৮)
- তিন কুল (সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক, সূরা নাস): ’আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, প্রতি রাতে নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিছানায় যাওয়ার প্রাক্কালে সূরাহ ইখ্লাস, সূরাহ ফালাক ও সূরাহ নাস পাঠ করে দু’হাত একত্র করে হাতে ফুঁক দিয়ে যতদূর সম্ভব সমস্ত শরীরে হাত বুলাতেন। মাথা ও মুখ থেকে আরম্ভ করে তাঁর দেহের সম্মুখ ভাগের উপর হাত বুলাতেন এবং তিনবার এরূপ করতেন। (বুখারি, হাদিস: ৫০১৭) *
- আয়াতুল কুরসি: প্রতিদিন ফরজ নামাজের পর এবং রাতে ঘুমানোর আগে আয়াতুল কুরসি পাঠকারী আল্লাহর সুরক্ষায় থাকে।
৩. “মাশাআল্লাহ” ও “বারাকাল্লাহ” বলা: যখন নিজের কোনো কিছু (যেমন—সন্তান, সম্পদ) বা অন্যের কোনো কিছু দেখে ভালো লাগে, তখন অবশ্যই “মাশাআল্লাহ, লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ” অথবা “বারাকাল্লাহু ফিক” বলা। এটি নিজের নজর থেকেও রক্ষা করে।
৪. নিয়ামত গোপন রাখা (বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায়): সবকিছু শেয়ার করা থেকে বিরত থাকা। নিজের সুখ, সাফল্য, সম্পদ, এমনকি ইবাদতকেও লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার চেষ্টা করা। মনে রাখতে হবে, আপনার সব “বন্ধু” বা “ফলোয়ার” আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী নয়।
খ. প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা:
যদি কেউ বদনজরে আক্রান্ত হয়েই যায়, তবে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সুন্নাহ:
১. রুকইয়াহ শার’ইয়াহ: আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর ঝাড়ফুঁক করা। এর মধ্যে রয়েছে—সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি, সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পাঠ করে ফুঁ দেওয়া। এছাড়াও এই দোয়াটি পড়া:
আবূ সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। জিবরাঈল (আ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট এসে বলেনঃ হে মুহাম্মাদ! আপনি কি রোগাক্রান্ত হয়েছেন? তিনি বলেনঃ হ্যাঁ। জিবরীল (আ) বলেন, ’’বিছমিল্লাহি আরকীকা মিন কুল্লি শায়ইন ইউযীকা মিন শাররি কুল্লি নাফসিন আও আয়নিন আও হাসিদিন, আল্লাহ ইয়াশফীকা বিসমিল্লাহি আরকীকা ’’ (আমি আল্লাহর নামে এমন প্রতিটি জিনিস থেকে আপনাকে ঝাড়ফুঁক করছি যা আপনাকে কষ্ট দেয়, প্রতিটি সৃষ্টিজীবের এবং প্রতিটি চোখের এবং প্রতিটি হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আপনাকে ঝাড়ফুঁক করছি। আল্লাহ আপনাকে আরোগ্য দান করুন। আমি আল্লাহর নামে আপনাকে ঝাড়ফুঁক করছি)। (সুনান ইবনু মাজাহ, হাদিস: ৩৫২৩)
২. ওজু বা গোসলের পানি: যেমন সাহল ইবনে হুনাইফের ঘটনায়।
৩. তাওয়াক্কুল: পূর্ণ ভরসা রাখা যে, আল্লাহই আরোগ্য দানকারী। কোনো প্রতিকার পদ্ধতি নিজস্ব ক্ষমতায় কাজ করে না, কেবল আল্লাহর হুকুমেই করে।
বদনজর কোনো কাল্পনিক ভয় বা কুসংস্কার নয়, এটি কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত একটি কঠিন বাস্তবতা। আধুনিক যুগের লাগামছাড়া প্রদর্শনীর সংস্কৃতি, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার, এই অদৃশ্য বিপদকে আমাদের ঘরের ভেতরে পৌঁছে দিয়েছে।
এর ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে। প্রতিটি নিয়ামতের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে এবং তা প্রদর্শনের বদলে গোপন রাখার অভ্যাস করতে হবে। নিজের অন্তরকে অন্যের প্রতি হিংসা থেকে পবিত্র করতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, সকাল-সন্ধ্যার জিকির ও দোয়াগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার সুরক্ষা লাভ করতে হবে। কারণ, একমাত্র আল্লাহই পারেন সব ধরনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অনিষ্ট থেকে আমাদের রক্ষা করতে।