একনজরে...
❁ ফিতরাত ❁
আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করাটা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। এই সহজাত বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় ফিতরাত। এটি প্রত্যেক মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য যার মাধ্যমে সে আল্লাহর অস্তিত্বের বাস্তবতা স্বীকার করে ও আল্লাহর নির্দেশ পালন করে। যিনি আমাদেরকে, চারপাশের এই পৃথিবীটাকে এবং পৃথিবীর ভিতরে যা কিছু আছে সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন, এমন একজন সুমহান সত্তার অস্তিত্বের ব্যাপারে অটল সাক্ষ্য দেবার সহজাত প্রবণতা এই ফিতরাত। এটা একটা উপহার, যা খোদাই করা মানুষের আত্মায় আত্মায়। ফলে যারা আল্লাহর হিদায়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের মাঝেও এই জন্মগত বৈশিষ্ট্যটা রয়েই যায়। সূরাহ রুমে আল্লাহ এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন,
তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ। এটাই আল্লাহর প্রকৃতি (ফিতরাত), যার উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই। এটাই সরল ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।’ (সূরাহ রুম | আয়াত ৩০)
❁ ফিতরাত হতে বিচ্যুতি ❁
বিভিন্ন বাহ্যিক প্রভাবে মানুষ সহজাত ধর্ম (ফিতরাত) থেকে বিচ্যুত হয়ে যেতে পারে। যেমন- পিতামাতার প্রভাব, সমাজের প্রভাব ইত্যাদি।
✅ ফিতরাতের উপর পিতামাতার প্রভাব :
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি নবজাতকই জন্মলাভ করে ফিতরাতের উপর। এরপর তা মা-বাপ তাকে ইহুদি বা খ্রিস্টান বা অগ্নিপূজারী রূপে গড়ে তোলে। যেমন, চতুষ্পদ পশু যখন একটি (পূর্ণাংগ) বাচ্চা জন্ম দেয় তখন কি তোমরা তার কানকাটা দেখতে পাও? এরপর আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু তিলাওয়াত করলেন- “আল্লাহর দেওয়া ফিতরাতের অনুসরণ কর, যে ফিতরাতের উপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, এটাই সরল সুদৃঢ় দ্বীন’ (সূরাহ রূম: ৩০)। (বুখারি, মুসলিম)
✅ পরিবেশের প্রভাব : এটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (সা.) হাদিসে জানিয়েছেন যে, পরিবেশের প্রভাব একজন ব্যক্তিকে সরল পথ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত করতে পারে, এমনকি পথভ্রষ্ট বিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠানের অনুসারী বানাতে পারে।
✅ শয়তানের প্রভাব : শয়তানও মানুষকে সহজাত বৈশিষ্ট্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
‘সাবধান, আমার প্রতিপালক আজ আমাকে যা কিছু শিক্ষা দিয়েছেন, তা থেকে তোমাদেরকে এমন বিষয়ের শিক্ষা দেয়ার জন্য তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যা সম্পর্কে তোমরা সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞ। তা হলো এই যে, (আল্লাহ বলেন), ‘আমি আমার বান্দাদেরকে যে ধন-সম্পদ দেব তা পরিপূর্ণরূপে হালাল। আমি আমার সমস্ত বান্দাদেরকে একনিষ্ঠ (মুসলিম) হিসাবে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তাদের নিকট শয়তান এসে তাদেরকে দ্বীন হতে বিচ্যুত করে দেয়। আমি যে সমস্ত জিনিস তাদের জন্য হালাল করেছিলাম সে তা হারাম করে দেয়। অধিকন্তু সে তাদেরকে আমার সাথে এমন বিষয়ে শিরক করার জন্য নির্দেশ দিল, যে বিষয়ে আমি কোনো সনদ পাঠাইনি।’ (সহীহ মুসলিম)
❁ ফিতরাতের বাস্তবতার প্রমাণ ❁
ফিতরাতের বাস্তবতার প্রমাণ হলো, যখন মানুষ বিভিন্ন উত্থানপতনের কারণে দুর্দশাগ্রস্থ হয় এবং কষ্টভোগ করে, তখন সহজাতভাবেই আল্লাহর কাছে চায়। এ বিষয়টি কুরআনের অনেক আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে। এছাড়া, প্রত্যেকে নিজের জীবনের অসংখ্য অভিজ্ঞতা থেকেও এই বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারে।
আল্লাহ বলেছেন,
‘মানুষকে যখন দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে আমাকে ডাকতে শুরু করে, এরপর আমি যখন তাকে আমার পক্ষ থেকে নিয়ামত দান করি, তখন সে বলে, এটা তো আমি পূর্বের জানা মতেই প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ এটা এক পরীক্ষা, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বোঝে না।’ (সূরাহ যুমার, ৩৯:৪৯)
• অন্যত্র বলেছেন,
‘যখন মানুষকে দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে একাগ্রচিত্তে তার পালনকর্তাকে ডাকে, অতঃপর তিনি যখন তাকে নিয়ামত দান করেন, তখন সে কষ্টের কথা বিস্মৃত হয়ে যায়, যার জন্যে পূর্বে ডেকেছিল এবং আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করে; যাতে করে অপরকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করে। বলুন, তুমি তোমার কুফর সহকারে কিছুকাল জীবনোপভোগ করে নাও। নিশ্চয় তুমি জাহান্নামীদের অন্তর্ভূক্ত।’ (সূরাহ যুমার ৩৯:৮)
• অন্যত্র বলেছেন,
“আমি যখন মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করি তখন সে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং পার্শ্ব পরিবর্তন করে। আর যখন তাকে অনিষ্ট স্পর্শ করে, তখন সুদীর্ঘ দোয়া করতে থাকে।’ (সুরাহ ফুসসিলাত, ৪১:৫১)
অন্যত্র বলেছেন,
“আর যখন মানুষ কষ্টের সম্মুখীন হয়, শুয়ে বসে, দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকতে থাকে। তারপর আমি যখন তা থেকে মুক্ত করে দেই, সে কষ্ট যখন চলে যায় তখন মনে হয়। কখনো কোন কষ্টেরই সম্মুখীন হয়ে যেন আমাকে ডাকেইনি। এমনিভাবে মনঃপুত হয়েছে নির্ভয় লোকদের যা তারা করেছে।’ (সূরাহ ইউনুস, ১০:১২ )
• অন্যত্র বলেছেন,
“তিনিই তোমাদের ভ্রমন করান স্থলে ও সাগরে। এমনকি যখন তোমরা নৌকাসমূহে আরোহণ করলে আর তা লোকজনকে অনুকূল হাওয়ায় বয়ে নিয়ে চলল এবং তাতে তারা আনন্দিত হল, নৌকাগুলোর উপর এল তীব্র বাতাস, আর সর্বদিক থেকে সেগুলোর উপর ঢেউ আসতে লাগল এবং তারা জানতে পারল যে, তারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে, তখন ডাকতে লাগল আল্লাহকে তাঁর ইবাদাতে নিঃস্বার্থ হয়ে যদি তুমি আমাদেরকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করে তোল, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।
তারপর যখন তাদেরকে আল্লাহ বাঁচিয়ে দিলেন, তখনই তারা পৃথিবীতে অনাচার করতে লাগল অন্যায় ভাবে। হে মানুষ! শোন, তোমাদের অনাচার তোমাদেরই উপর পড়বে। পার্থিব জীবনের সুফল ভোগ করে নাও-অতঃপর আমার নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তখন আমি বাতলে দেব, যা কিছু তোমরা করতে।’ (সূরাহ ইউনুস, ১০:২২-২৩)
দুঃখ-দুর্দশায় আক্রান্ত হওয়ার পেছনে বিভিন্ন হিকমত রয়েছে। মানুষের জীবনে নানা পরিস্থিতির কারণে বিশুদ্ধ ফিতরাতের উপর প্রলেপ জমতে থাকে। কষ্ট-মুসিবতের দ্বারা দূরীভূত হয়ে যায় এই জমে থাকা কুফর ও বিভ্রান্তির আবরণ। কখনও কখনো এসবের অনেক গভীরে তলিয়ে যায় ফিতরাত। অথচ এই মানুষটিও যখন বিপদে পড়ে, তখন এমন এক সত্তার কাছে আকুতি জানায়, যার সম্পর্কে সে মনেপ্রাণে জানে যে এই কঠিন বিপদে একমাত্র তিনিই সাহায্য প্রদান করতে সক্ষম! বিপদে পড়লে সাহায্য কামনা মানুষের একটি স্বয়ংক্রিয় সহজাত বৈশিষ্ট্য। যদি আমরা কোনো বাস্তব ভিডিওচিত্রে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পতিত মানুষের অবস্থা দেখি, তাহলে সেখানেও দেখা যায় অধিকাংশ বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি (যদিও বা তারা অমুসলিম) ‘গড’ এর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছে কোনো না কোনোভাবে!
বইঃ সাইকোলজি: ইসলামি দৃষ্টিকোণ (ড. আইশা হামদান)