রোযা হল এক এমন ইবাদত, যার মাধ্যমে বান্দা প্রভুর নৈকট্যলাভ করতে সক্ষম হয়। এতে সে প্রকৃতিগতভাবে যে জিনিস ভালোবাসে তা বর্জন করে; বর্জন করে সকল প্রকার পানাহার ও যৌনক্রিয়া। আর এর মাধ্যমে সে নিজ প্রতিপালকের সন্তুষ্টি কামনা করে। আশা করে পরকালের সাফল্য ও বেহেশতলাভ। এতে এই কথাই স্পষ্ট হয় যে, সে নিজের প্রিয় বস্তুর উপর প্রভুর প্রিয় বস্তুকে প্রাধান্য দেয় এবং ইহকালের জীবনের উপর পরকালের জীবনকেই শ্রেষ্ঠত্ব দেয়। তাই বান্দার এই ত্যাগের প্রতিদানের পুরষ্কার মহান আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতে দিবেন।
বরকতময় এই রামাদান মাসকে বছরের শ্রেষ্ঠ মাসে রুপান্তরিত করার এটাই সুযোগ। প্রকৃতপক্ষে রমজান হলো পূর্বের সকল গুনাহর জন্য ক্ষমা চেয়ে সাচ্চা মুসলমান হয়ে জীবনযাপনের প্রতিজ্ঞা করার মাস। এ মাসের সময়গুলো খুব বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগিতে অতিবাহিত করা উচিত। রমাদানকে বরকতময় করতে ২৭টি বিশেষ আমলের কথা আলোচনা করা হলঃ
একনজরে...
১. রমজানের চাঁদ দেখা
রমজান মাসের চাঁদের উদয় মুমিন জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। সাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ।
নতুন চাঁদ দেখার পর নবী ﷺ সাল্লাম বলতেনঃ
اللَّهُمَّ أهِلَّهُ عَلَيْنا باليُمْنِ وَالْإِيْمَانِ وَالسَّلامَةِ وَالإِسْلَامِ رَبِّي وَرَبُّكَ اللَّهُউচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল ইয়ূমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াসসালামাতি ওয়াল ইসলামি রাব্বি ও রাব্বুকাল্লাহ।
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য এ চাঁদকে সৌভাগ্য, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সাথে উদিত করুন। হে চাঁদ! আল্লাহই হলেন আমার প্রভু এবং তোমারও প্রভু। (তিরমিজি ৩৪৫১)
(এ দোয়া শুধু রমজানের চাঁদ দেখলেই নয় যে কোনো মাসের নতুন চাঁদ দেখে বলা সুন্নত।)
রাসূল ﷺ রমজানের কথা আলোচনা করে বলেছেন,
চাঁদ না দেখে তোমরা সওম পালন করবে না এবং চাঁদ না দেখে ইফ্তার বন্ধ করবে না। যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে তার সময় (ত্রিশ দিন) পরিমাণ পূর্ণ করবে। (সহীহ বুখারী ১৯০৬)
চাঁদ দেখা ফরজে কেফায়া। অর্থাৎ মুসলিম সমাজের কিছু মানুষ চাঁদ দেখলেই সবার পক্ষ থেকে দেখা হয়ে যাবে। আর কেউ না দেখলে সবাই গুনাহগার হবে।
মহানবী ﷺ বলেছেন,
তোমরা চাঁদ দেখে সিয়াম আরম্ভ করবে এবং চাঁদ দেখে ইফতার করবে। (সহীহ বুখারী ১৯০৯)
২. রোজা রাখা
ইসলামের ৫টি স্তম্ভের মধ্যে সিয়াম বা রোজা অন্যতম একটি স্তম্ভ। হাদিসে কুদসীতে আল্লাহ তায়ালা রোজার প্রতিদান নিজ হাতে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। (সূরা বাকারা ২:১৮৩)
আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেনঃ
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, সওম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম আমার জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দেব। (সহীহ বুখারী ১৯০৪)
৩. তারাবির নামাজ আদায় করা
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
আমি আল্লাহর রাসূল ﷺ -কে রমাযান সম্পর্কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি রমাযানে ঈমানের সাথে সওয়াব লাভের আশায় কিয়ামে রমাযান অর্থাৎ তারাবীহর সালাত আদায় করবে তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী ২০০৮)
৪. সাহরী করা
নবী ﷺ বলেছেনঃ
তোমরা সাহরী খাও, কেননা সাহরীতে বরকত রয়েছে। (সহীহ বুখারী ১৯২৩)
৫. সাহরী রাতের শেষ প্রহরে খাওয়া
যায়দ ইবনু সাবিত (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সঙ্গে সাহারী খেয়েছেন, অতঃপর ফজরের সালাতে দাঁড়িয়েছেন। আনাস (রাযি.) বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ দু’য়ের মাঝে কতটুকু সময়ের ব্যবধান ছিলো? তিনি বললেন, পঞ্চাশ বা ষাট আয়াত তিলাওয়াত করা যায়, এরূপ সময়ের ব্যবধান ছিলো। (সহীহ বুখারী ১৯২১)
মহানবী ﷺ এর সাহাবাগণ খুব তাড়াতাড়ি (সময় হওয়া মাত্র) ইফতার করতেন এবং খুব দেরী করে সেহরী খেতেন। (বাইহাকী ৪/২৩৮, ইবনে আবী শাইবাহ, মুসান্নাফ ৮৯৩২নং)
৬. ইফতার করা
আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেছেনঃ
যখন রাত্র সে দিক হতে ঘনিয়ে আসে ও দিন এ দিক হতে চলে যায় এবং সূর্য ডুবে যায়, তখন রোযাদার ইফতার করবে। (সহীহ বুখারী ১৯৫৪)
৭. ইফতার তাড়াতাড়ি করা
রোযার নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে রোযা খোলা বা ইফতার করার জন্য প্রত্যেক রোযাদারের অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করাটাই স্বাভাবিক। আর সেই সময় যে তার রোযা পূর্ণ করতে পারে প্রকৃতিগতভাবে সে খুশী হয়। অতএব ইফতার করতে তাড়াতাড়ি করাটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু তা সত্ত্বেও দয়ার নবী ﷺ আমাদেরকে সত্বর ইফতার করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং জানিয়েছেন যে, তাতে আমাদের মঙ্গল আছে।
তিনি ﷺ বলেন, ‘‘লোকেরা ততক্ষণ মঙ্গলে থাকবে, যতক্ষণ তারা (সূর্য ডোবার পর নামাযের আগে) ইফতার করতে তাড়াতাড়ি করবে।’’ (সহীহ বুখারী ১৯৫৭)
সময় হওয়ার সাথে সাথে শীঘ্র ইফতার করা নবুঅতের একটি আদর্শ। মহানবী ﷺ বলেন,
‘‘তিনটি কাজ নবুয়তের আদর্শের অন্তর্ভুক্ত; জলদি ইফতার করা, দেরী করে (শেষ সময়ে) সেহরী খাওয়া এবং নামাযে ডান হাতকে বাম হাতের উপর রাখা।’’ (ত্বাবারানী, মু’জাম, মাজমাউয যাওয়ায়েদ ২/১০৫, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৩০৩৮নং)
৮. ইফতারের দোয়া (বিসমিল্লাহ বলে শুরু ও শেষে দোয়া পড়া)
রোযাদারের উচিৎ, ইফতার করার আগে পর্যন্ত রোযা থাকা অবস্থায় বেশী বেশী করে দুআ করা। কারণ, রোযা থাকা অবস্থায় রোযাদারের দুআ আল্লাহর নিকট মঞ্জুর হয়। মহানবী ﷺ বলেন,
‘‘তিন ব্যক্তির দুআ অগ্রাহ্য করা হয় না (বরং কবুল করা হয়); পিতার দুআ, রোযাদারের দুআ এবং মুসাফিরের দুআ।’’ (বাইহাকী ৩/৩৪৫, প্রমুখ, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৭৯৭নং)
ইফতারের খাবার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা। ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে ভুলে গেলে
بِسْمِ اللهِ أَوَّلَهُ وَآخِرَهُউচ্চারণঃ– বিসমিল্লা-হি আউওয়ালাহু অ আ-খিরাহ। (আবূ দাঊদ ৩৭৬৭)
খাওয়া শেষ হলে ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ বলতে হয়। যেহেতু কিছু খাওয়া অথবা পান করার পরে বান্দা আল্লাহর প্রশংসা করুক এটা তিনি পছন্দ করেন। (মুসলিম ২৭৩৪)
(উপরোক্ত দোয়াসমূহ যেকোনো খাবার খাওয়ার সময়ই বলতে হয়)
ইবনে উমার (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী ﷺ ইফতার করলে এই দুআ বলতেন,
ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوْقُ وَثَبَتَ ألأَجْرُ إِنْ شَاءَ الله.উচ্চারণঃ- যাহাবায যামা-উ অবতাল্লাতিল উরুক্বু অষাবাতাল আজরু ইনশা-আল্লাহ।
অর্থ- পিপাসা দূরীভূত হল, শিরা-উপশিরা সতেজ হল এবং ইনশা-আল্লাহ সওয়াব সাব্যস্ত হল। (আবূ দাঊদ ২৩৫৭)
৯. ইফতার ও সাহরীতে খেজুর খাওয়া
নবী ﷺ বলেনঃ
ঈমানদার ব্যক্তির জন্য খেজুর দিয়ে সাহারী খাওয়া কতোই না উত্তম! (আবূ দাউদ ২৩৪৫)
আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল ﷺ নামাযের পূর্বে কিছু আধা-পাকা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তা না পেলে পূর্ণ পাকা (শুকনা) খেজুর দিয়ে এবং তাও না পেলে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিতেন।’ (আবূ দাঊদ ২৩৫৬)
আল্লাহর রসূল ﷺ বলেছেন,
“যে ব্যক্তি খেজুর পায়, সে যেন তা দিয়ে ইফতার করে। যে ব্যক্তি তা না পায়, সে যেন পানি দিয়ে ইফতার করে। কারণ, তা হল পবিত্র।” (সহীহুল জামেউস সাগীর ৬৫৮৩)
১০. দিনভর আল্লাহর কাছে দোয়া করা
রাসুল ﷺ বলেছেন: ‘তিন ধরনের লোকের দোয়া কখনো ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। ১. রোজাদার যখন ইফতার করে, ২. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া, ৩. মজলুমের দোয়া। মজলুম ব্যক্তির দোয়া আল্লাহ মেঘমালার ওপর উঠিয়ে নেন এবং এ জন্য আসমানের সব দরজা খুলে দেওয়া হয়। আল্লাহ বলেন, আমার ইজ্জতের কসম! আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব, যদিও তা কিছুকাল পরে হয়।’ (তিরমিজী ৩৫৯৮)
১১. সকল প্রকার পাপাচার বর্জন করা
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
শাইতান ও দুষ্ট জিনদেরকে রামাযান মাসের প্রথম রাতেই শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয় এবং এর দরজাও তখন আর খোলা হয় না, খুলে দেওয়া হয় জান্নাতের দরজাগুলো এবং এর একটি দরজাও তখন আর বন্ধ করা হয় না। (এ মাসে) একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিতে থাকেনঃ হে কল্যাণ অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে পাপাসক্ত! বিরত হও। আর বহু লোককে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ হতে এ মাসে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং প্রত্যেক রাতেই এরূপ হতে থাকে। (তিরমিজী ৬৮২)
১২. মিথা কথা, কাজ ও প্রতারণা না করা
নবী ﷺ বলেছেন:
যে লোক মিথ্যা কথা এবং সে অনুসারে কাজ করা আর মূর্খতা পরিহার করলো না, আল্লাহর নিকট তার পানাহার বর্জনের কোন প্রয়োজন নেই। (সহীহ বুখারী ৬০৫৭)
১৩. ঝগড়াবিবাদ থেকে দূরে থাকা
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
সিয়াম ঢাল স্বরূপ। সুতরাং অশ্লীলতা করবে না এবং মূর্খের মত কাজ করবে না। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, তাকে গালি দেয়, তবে সে যেন দুই বার বলে, আমি সওম পালন করছি। ঐ সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, অবশ্যই সওম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিসকের সুগন্ধির চাইতেও উৎকৃষ্ট, সে আমার জন্য আহার, পান ও কামাচার পরিত্যাগ করে। সিয়াম আমারই জন্য। তাই এর পুরস্কার আমি নিজেই দান করব। আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশ গুণ। (সহীহ বুখারী ১৮৯৪)
তিনি ﷺ আরও বলেন,
তোমাদের কেউ যেন সিয়াম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন রোজাদার। (সহীহ বুখারী ১৯০৪)
১৪. সাধারণ আমল ও ভালো কাজগুলো সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে করা
রমজান মাস বছরের শ্রেষ্ঠ সময়। এই মাসে নেক আমলের সওয়াব আল্লাহ তাআলা অনেক বেশি বাড়িয়ে দেন। সাধারণ যত ভালো কাজ আছে তা এই মাসে বেশি গুরুত্ব সহকারে পালন করা।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
‘‘তোমাদের নিকট রমযান মাস উপস্থিত হয়েছে, যা একটি বরকতময় মাস। তোমাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলা এ মাসের সাওম ফরয করেছেন।” (মুসনাদে আহমদ ৭১৪৮)
এই পবিত্র মাস আমল করার মৌসুম। নিজের আমল নামার শুন্যস্থানগুলো পূরণ করার সময়। জান্নাতের পথে এগিয়ে যাওয়ার সময়। সকল ধরনের নেক আমল করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।
১৫. গুরুত্ব সহকারে আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়া বা ইস্তেগফার করা
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
আল্লাহ্ তা’আলা প্রতি ইফতারের অর্থাৎ প্রতি রাতে বেশ সংখ্যক লোককে (জাহান্নাম থেকে) মুক্তি দেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ১৬৪৩)
তিনি ﷺ আরও বলেন,
ভূলুষ্ঠিত হোক তার নাক যার নিকট রমযান মাস এলো অথচ তার গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়ার পূর্বেই তা পার হয়ে গেল। (তিরমিজি ৩৫৪৫)
রমজান মাস আল্লাহর কাছে বেশি বেশি তাওবা ইস্তেগফার করার সময়। তাই রমজানের দিনগুলোতে নিজের গুনাহ মাফের চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। আমিন।
১৬. রোযাদারকে ইফতার করানো
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ যে ব্যক্তি রোযাদারকে ইফতার করায়, তার জন্য রয়েছে ইফতারকারীদের সমান সওয়াব এবং এজন্য তাদের সওয়াব থেকে কিছুই হ্রাসপ্রাপ্ত হবে না। (সুনান ইবনু মাজাহ ১৭৪৬)
১৭. বিশেষ গুরুত্বের সাথে কুরআন তেলাওয়াত করা
রমজান কোরআন নাজিলের মাস। রমজানের রোজা রেখে কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে ক্ষমা ও রহমত কামনা করার সুবর্ণ সুযোগ।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, রমাযান মাস- যার মধ্যে কুরআন নাযিল করা হয়েছে লোকেদের পথ প্রদর্শক এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট বর্ণনারূপে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। (সূরা বাকারা ২:১৮৫)
১৮. কুরআন শোনা ও শুনানো
আল্লাহর নির্দেশে পবিত্র রমজান মাসে হজরত জিবরিল আলাইহিস সালাম প্রিয়নবি ﷺ কে পুরো কুরআন পড়ে শোনাতেন আর প্রিয়নবি ﷺ তা শুনতেন এবং তিনি তা তেলাওয়াত করতেন হজরত জিবরিল আলাইহিস সালামও তা শুনতেন।
তাই পবিত্র এই মাসে আমাদের পরিবারে নিজেদের বন্ধুবান্ধবের মধ্যে কুরআন শুনানো ও শুনার প্রতিযোগীতা করা উচিত। এছাড়াও কুরআনের অর্থ ব্যাখাসহ বুঝার চেষ্টা করা উচিত।
১৯. সাদাকা বা দান করা
মাহে রমজান মানুষকে দানশীলতা, বদান্যতা, উদারতা ও মহত্বের শিক্ষা দেয়। কোনো প্রকার অপচয় না করে রোজার মাসে মানুষের সেবায় দান-সদকা করলে অভাবক্লিষ্ট মানুষের কল্যাণ হয় এবং মানবতা উপকৃত হয়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী! তাদের ধন-সম্পদ থেকে সদকা নিয়ে তাদেরকে পাক-পবিত্র করুন, (নেকির পথে) তাদের এগিয়ে দিন এবং তাদের জন্য রহমতের দোয়া করুন। (সুরা তওবা আয়াত ১০৩)
নবী ﷺ ধন-সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সকলের চেয়ে দানশীল ছিলেন। রমযানে জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন তাঁর সাথে দেখা করতেন, তখন তিনি আরো অধিক দান করতেন। রমযানের প্রতি রাতেই জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁর সাথে একবার সাক্ষাৎ করতেন। আর নবী ﷺ তাঁকে কুরআন শোনাতেন। জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি রহমত প্রেরিত বায়ূর চেয়ে অধিক ধন-সম্পদ দান করতেন। (সহীহ বুখারী ১৯০২)
২০. সাহরী খেতে উঠার পর তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া
রমজান ইবাদতের মৌসুম। রমজানে সাহরির সুবাদে তাহাজ্জুদ পড়া খুবই সহজ। সাহরির সময়ই তাহাজ্জুদের সময়।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, আর রাত্রির কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়, ওটা তোমার জন্য নফল, শীঘ্রই তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রশংসিত স্থানে উন্নীত করবেন। (সূরা ইসরা ১৭:৭৯)
পাঁচওয়াক্ত সালাতে মসজিদে মুয়াজ্জিন ডাকে কিন্তু তাহাজ্জুদের জন্য আল্লাহ স্বয়ং নিজেই বান্দাদের ডাকেন। রসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেনঃ প্রতি রাত্রে শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের মর্যাদাবান বারাকাতপূর্ণ রব দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, ’যে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব। যে আমার নিকট কিছু প্রার্থনা করবে আমি তাকে তা দান করব। যে আমার নিকট মাফ চাইবে আমি তাকে মাফ করে দেব।
মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, তারপর তিনি হাত বাড়িয়ে দেন এবং বলেন, কে আছে যে এমন সত্তাকে কর্য দেবে যিনি ফকীর নন, না অত্যাচারী এবং সকাল পর্যন্ত এ কথা বলতে থাকেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ ১২২৩)
২১. সামর্থ্য থাকলে উমরা করা
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
রমাযান এলে তখন ‘উমরাহ করে নিও। কেননা, রমযানের একটি ‘উমরাহ একটি হাজ্জের সমতুল্য। (সহীহ বুখারী ১৭৮২)
অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ রমজান মাসের ওমরাহ হজ আমার সাথে বড় হজ করার সমান। (সহীহ মুসলিম ১২৫৬)
২২. রোজা রেখে বেশি বেশি মেসওয়াক করা
মেসওয়াক অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাত। তাই রোজার সময়ও সকাল, দুপুর, বিকালসহ সব নামাজের সময় ওজুতে মেসওয়াক করা সর্বোত্তম আমল। সব অবস্থায়ই রোজাদারের মুখের ঘ্রাণ আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয়।
২৩. রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফে বসা
ইতিকাফ মাহে রমজানের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ইতিকাফ করতেন। সাহাবায়ে কেরামগণও ইতিকাফ করতেন।
ইবনে উমার (রা.) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহﷺ রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন।’ (মুসলিম ১১৭১)
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
যে বছর তিনি ইন্তিকাল করেন সে বছর তিনি বিশ দিনের ইতিকাফ করেছিলেন। (সহীহ বুখারী ২০৪৪)
২৪. রমজানের শেষ ১০ দিন বেশি বেশি ইবাদত করা
‘আয়িশাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
যখন রমাযানের শেষ দশক আসত তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত্র জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। (সহীহ বুখারী ২০২৪)
২৫. লাইলাতুল কদর তালাশ করা
রমজানের শেষ দশকে শান্তির বার্তা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,
‘নিশ্চয়ই আমি একে নাজিল করেছি মহিমান্বিত রাতে (লাইলাতুল কদর)। আপনি কি জানেন মহিমান্বিত রাত কী? মহিমান্বিত রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। সেই রাতে প্রতিটি কাজের জন্য ফেরেশতারা এবং রুহ তাদের প্রতিপালকের আদেশক্রমে অবতীর্ণ হয়। সেই রাতে শান্তিই শান্তি, ফজর হওয়া পর্যন্ত।’ (সূরা কদর ৯৭:১-৫)
বিভিন্ন হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, উল্লিখিত আয়াতে মহিমান্বিত যে রাতের কথা বলা হয়েছে, তা এই শেষ দশকেই লুকিয়ে আছে। রাসুলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন,
তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান করো। (সহীহ বুখারি ২০১৭)
নবী ﷺ বলেছেনঃ
যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রাত জেগে ‘ইবাদত করে, তার পিছনের সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমাযানে সিয়াম পালন করবে, তারও অতীতের সমস্ত গোনাহ মাফ করা হবে। (সহীহ বুখারী ১৯০১)
২৬. লাইলাতুল কদর পেয়ে গেলে বিশেষ দোয়া করা
আয়িশাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি “লাইলাতুল কদর” জানতে পারি তাহলে সে রাতে কি বলব? তিনি বললেনঃ “তুমি বল,
اَللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ كَرِيمٌ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيউচ্চারণঃ– আল্লা-হুম্মা, ইন্নাকা ‘আফুওউন্ কারীম, তু’হিব্বুল ‘আফ্ওয়া ফা’অ্ফু ‘আন্নী
অর্থঃ হে আল্লাহ্! তুমি ক্ষমাশীল, মহানুভব! তুমি ক্ষমা করতে পছন্দ করো। অতএব, আমাকে ক্ষমা করে দাও। (তিরমিযী ৩৫১৩)
২৭. রমজানের শেষে ফিতরা দেওয়া (গরিবদের বাসায় খাবার পৌছে দেওয়া)
রমজানের রোজা রাখার সময় অনিচ্ছাকৃত যেসব ভুল-ত্রুটি হয়েছে, সেসব থেকে পবিত্র হওয়াই ফিতরা দেওয়ার উদ্দেশ্য। সাদাকাতুল ফিতর দ্বারা রোজা পালনের সব দোষত্রুটি দূরীভূত হয়, গরিবের পানাহারের ব্যবস্থা হয়।
(আবদুল্লাহ) ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত যে,
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদেরকে ঈদের সালাতের উদ্দেশে বের হওয়ার পূর্বেই সদাকাতুল ফিত্র আদায় করার নির্দেশ দেন। (সহীহ বুখারী ১৫০৯)
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উক্ত আমলগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পালন করার তৌফিক দান করুন, আমিন। এই রামাদানে আমরা চাই আল্লাহ্ যেন আমাদের ক্ষমা করে দেন। রামাদানে আমাদের লক্ষ্য হবে আল্লাহর সিংহাসন যেন জান্নাতে আমাদের ছাদ হয়, আল্লাহ্ যেন আমাদেরকে তাঁর আরশ মহলে সম্মানিত করেন। প্রিয় নবিজি ﷺ এর সাথে, সাহাবিদের সাথে, রাহমানের বান্দাদের সাথে—আল্লাহ যেন আমাদেরকেও জান্নাতুল ফিরদাউসের অধিবাসী করে নেন। আমীন।
- এই পোস্টটি বই ভার্সন ডাউনলোড করুন: এখানে ক্লিক করুন।